Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

পুলিশ নিগ্রহেও রেহাই মেয়রের ভাইঝির

মুখ্যমন্ত্রীর এক ভাইপোর পর মেয়রের ভাইঝি। ফের নিগৃহীত পুলিশ। বছর তিনেক আগে খিদিরপুরে এক পুলিশ অফিসারকে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ভাইপো আকাশের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সে দিন আকাশকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। শুক্রবার রাতে রাসবিহারী মোড়ে ট্রাফিক আইন ভাঙার পর উল্টে পুলিশকেই নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠল কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি দেবপ্রিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০২:৪৮
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর এক ভাইপোর পর মেয়রের ভাইঝি। ফের নিগৃহীত পুলিশ।

বছর তিনেক আগে খিদিরপুরে এক পুলিশ অফিসারকে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ভাইপো আকাশের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সে দিন আকাশকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। শুক্রবার রাতে রাসবিহারী মোড়ে ট্রাফিক আইন ভাঙার পর উল্টে পুলিশকেই নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠল কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি দেবপ্রিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করা সত্ত্বেও এঁদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি টালিগঞ্জ থানা। বরং অভিযোগ, দেবপ্রিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের থানায় আনার সময় থেকেই একাধিক প্রভাবশালীর ফোন আসা শুরু হয়ে যায় কর্তব্যরত অফিসারদের কাছে।

কলকাতা পুরভোটের দিন গিরিশ পার্কে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এক পুলিশ অফিসার। তার মাত্র ক’দিন আগে পুলিশকে নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। প্রথম ঘটনার মূল অভিযুক্ত এখনও অধরা। দ্বিতীয় ঘটনায় অনায়াসে আগাম জামিন পেয়েছেন অভিযুক্ত। দু’ক্ষেত্রেই অভিযোগ, শাসক দলের তৎপরতায় পুলিশের উপরমহলেরই একাংশ এঁদের বিরুদ্ধে নিষ্পৃহ থেকেছে। শুক্রবার রাতের ঘটনার পর নিচুতলার পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। মেয়রের ভাইঝি ও তাঁর বন্ধুদের হাতে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও লালবাজার কাউকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল না কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। কেউ কেউ বলছেন, ‘‘কোথাও রাজনৈতিক নেতারা মারবেন, কোথাও তাঁদের আত্মীয়েরা। কতদিন এ ভাবে পড়ে পড়ে মার খাব আর হজম করব?’’

কী হয়েছিল শুক্রবার? পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে দেবপ্রিয়াদের গাড়িটি টালিগঞ্জ থানার দিক থেকে চেতলার দিকে যাওয়ার সময়ে রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যাল উপেক্ষা করে এক পথচারীকে ধাক্কা মারে। মেয়রের দাদা চন্দন চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে দেবপ্রিয়াই ছিলেন চালকের আসনে। গাড়িতে ছিলেন আরও দুই তরুণ ও দুই তরুণী। গাড়িটি ওই ব্যক্তিকে ধাক্কা মারার পর রাস্তায় ডিউটিতে থাকা এক ট্রাফিক কনস্টেবল সেটিকে থামানোর চেষ্টা করেন। টালিগঞ্জ থানায় দায়ের করা অভিযোগে ওই ট্রাফিক কনস্টেবল জানান, তিনি গাড়িটিকে থামানোর চেষ্টা করলে আরোহীরা তাঁর সঙ্গে বচসা শুরু করেন। প্রথমে গালিগালাজ ও হুমকি দেওয়া হয়। এর পর দেবপ্রিয়া বলেন, তিনি মেয়রের ভাইঝি। তাই ‘কেউ কিছু করতে পারবে না।’ পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এই যুবক-যুবতীরা প্রত্যেকেই মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। বচসার মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা ওই কনস্টেবলকে ধাক্কা মারেন বলে অভিযোগ। তাঁর ‘পকেট বুক’ কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়।

আক্রান্ত ট্রাফিক কনস্টেবলের ফোন পেয়ে টালিগঞ্জ থানা থেকে প্রিজন ভ্যান নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন এক সাব-ইন্সপেক্টর। ওই গাড়িতে চাপিয়েই দুই যুবককে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলা পুলিশ না থাকায় দেবপ্রিয়া-সহ তিন তরুণীকে তখন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। পরে লালবাজার থেকে মহিলা পুলিশ এলে তাঁদের সামনেই দেবপ্রিয়া ও তাঁর বন্ধুরা চিৎকার শুরু করেন। কেন তাঁদের বন্ধু দুই যুবককে আটক করা হয়েছে, সেই কৈফিয়ৎ চান তাঁরা।

মহিলা পুলিশেরা কোনও মতে তাঁদের নিরস্ত করে ফের গাড়িতে তুলে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেন। এ বার গাড়িটি কিছুটা এগিয়েই কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কাছে ফুটপাথে ফের ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে পড়ে। এ বার সেখানেও জমে যায় ভিড়। ফের চলে আসে পুলিশ। অভিযোগ, এ বারও তিন তরুণী পুলিশের সঙ্গে তুমুল বচসা জুড়ে দেন। পুলিশকে গালিগালাজ করা হচ্ছে দেখে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেও তত ক্ষণে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে বিরাট পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে এসে মেয়রের ভাইঝি-সহ তিন যুবতীকে টালিগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়।

পুলিশ সূত্রের দাবি, মোটামুটি এই সময়েই ওই পাঁচ জনকে ছেড়ে দেওয়ার তদ্বির করে প্রভাবশালীদের ফোন আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেবপ্রিয়াদের বিরুদ্ধে প্রথমে কোনও মামলা দায়ের করেনি পুলিশ। পরে ওই কনস্টেবলের অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মীদের কাজে জোর করে বাধা দেওয়া (৩৫৩ ধারা) এবং এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করার (১১৪ ধারা) অভিযোগ দায়ের হয়। এই দু’টি ধারাই জামিন অযোগ্য। তা সত্ত্বেও মামলা দায়ের করার পর তিন তরুণীকে রাতেই তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁদের বন্ধু দুই যুবককেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কেন গ্রেফতার করা হল না ওই পাঁচ জনকে?

লালবাজারের যুক্তি, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনও মহিলাকে গ্রেফতার করা যায় না। তাই দেবপ্রিয়াদের গ্রেফতার করা হয়নি। আর প্রাথমিক তদন্তে দেখা গিয়েছে, ওই দুই যুবককে গ্রেফতারের প্রয়োজন নেই। তাই তাঁদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের বিরুদ্ধেও অবশ্য নিগ্রহের পাল্টা অভিযোগ করেছেন ওই পাঁচ জন। ঘটনাচক্রে, শনিবার একটি অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে হাজির ছিলেন মেয়র ও পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। অভিযুক্তদের কেন গ্রেফতার করা হল না জানতে চাওয়া হলে সিপি বলেন, ‘‘অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্ত চলছে। এর বেশি কিছু বলা যাবে না।’’

কী বলছেন মেয়র? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার প্রথম বর্ষের ছাত্রী তাঁর ভাইঝির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে শোভনবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে। আমি ওই ঘটনায় পুলিশের কাজে কোনও হস্তক্ষেপ করিনি, করবও না।’’ দেবপ্রিয়ার বাবাকে ফোন করা হলে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি তো আপনার কাছেই প্রথম জানলাম!’’

সাধারণ পুলিশকর্মীরা অবশ্য মেয়র বা সিপি-র কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না। গত সপ্তাহেই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মানসিক ভারসাম্যহীন এক মহিলাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়ে মানিকতলা থানার তিন পুলিশকর্মী জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে মার খেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আক্রান্তদের মধ্যে এক মহিলা পুলিশকর্মীও ছিলেন। নীলরতনের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত বলেই এই ঘটনায় কোনও অভিযুক্তকে ধরা যায়নি বলে মনে করছেন অনেকে। ঠিক যে ভাবে এক তৃণমূল বিধায়কের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই গিরিশ পার্ক কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারিকে ধরা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, পুলিশেরই একাংশ পালাতে দিয়েছে গোপালকে। আলিপুরের তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার বিরুদ্ধে থানায় ঢুকে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ আগেই ছিল। ওই দিন টেবিলের তলায় ঢুকে পুলিশ অফিসারের ফাইল দিয়ে মুখ ঢাকার ছবি প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল।

কিন্তু সে বার তো প্রতাপকে ধরা যায়ইনি, উল্টে পুরভোটের আগে আলিপুরের গোপালনগরের মোড়ে ফের পুলিশ অফিসারদের নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ বার পুলিশ প্রতাপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। আত্মসমর্পণ করে হাসতে হাসতে আগাম জামিন নিয়ে বেরিয়ে যান প্রতাপ।

এ বার দাপট মেয়রের ভাইঝির। আইনরক্ষকদের একাংশের আক্ষেপ, কর্তাদের সৌজন্যে ঢাল-তলোয়ার নিয়েও নিধিরাম সর্দার হয়ে থাকাটাই যে ভবিতব্য, সেটা তাঁরা বেশ বুঝতে পারছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE