ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আলম আলি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
গিরিশ পার্কের বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে মহিলা খুনের পিছনে পরিচিত লোকের হাত আছে বলে সন্দেহ করছিল পুলিশ। মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পরে জানা গেল, নিছক পরিচয় নয়, প্রতিমা মাইতি নামে ওই মহিলার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাও ছিল তার। এবং মহিলা সেই ঘনিষ্ঠতার মাসুল দাবি করায় রাগের বশে সে তাঁকে খুন করেছে বলে পুলিশি জেরায় স্বীকার করেছে ধৃত অভিযুক্ত।
কী রকম মাসুল?
লালবাজার সূত্রের খবর, আলম আলি নামে ওই অভিযুক্ত পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, শনিবার রাতে প্রতিমার সঙ্গে তার যৌন সংসর্গ হয়। তার পরেই প্রতিমা তার কাছে টাকা দাবি করেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে বয়ান দিয়েছে আলম। বলেছে, টাকা না-পেলে চিৎকার করারও হুমকি দেন ওই মহিলা। তখনই রাগের চোটে সে প্রতিমাকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাস রোধ করে খুন করে। ধস্তাধস্তির সময় প্রতিমার মাথা দেওয়ালে ঠুকে যায়। প্রতিমার টাকা চাওয়ার বিষয়টি কতটা সত্য, তা যাচাই করা হচ্ছে।
আলমের হদিস মিলল কী ভাবে?
আলম যে প্রায়ই প্রতিমার বাড়িতে আসে, পড়শিরা তা জানতেন। শনিবারেও ভরদুপুরে সকলের সামনে দিয়েই ওই মহিলার ঘরে ঢুকেছিল সে। ঘর থেকে একাধিক বার বাইরেও যায়। সবই দেখেছিলেন ওই মহিলার কয়েক জন প্রতিবেশী। লালবাজারের গোয়েন্দারা বলছেন, প্রতিবেশীদের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে যাতায়াত করাটাই কাল হল আলমের। প্রতিবেশীদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে আলম ও প্রতিমার ফোনের কথোপকথন এবং মোবাইলের টাওয়ার ‘লোকেশন’ও মিলে যাওয়ায় আলমকে গ্রেফতার করা আরও সহজ হয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
সোমবার দুপুরে বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে একটি বাড়ির একতলার ঘরে বছর পঁয়তাল্লিশের প্রতিমার হাত-পা বাঁধা দেহ পাওয়া যায়। তিনি কয়েক বছর ওই বাড়িতে একাই ছিলেন। তাঁর স্বামী, বড় ছেলে থাকেন অন্ধ্রপ্রদেশে। ছোট ছেলেও চাকরি সূত্রে ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা। দেহ উদ্ধারের পরেই পুলিশ জানিয়েছিল, শনিবার রাতে খুন হয়েছেন প্রতিমা। মঙ্গলবার ময়না-তদন্তেও তার প্রমাণ মেলে।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বুধবার জানান, হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা মঙ্গলবার গভীর রাতে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থেকে আলমকে গ্রেফতার করেন। তার পরেই জেরার মুখে প্রতিমাকে খুনের কথা স্বীকার করে সে। দাসপুরের সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা জানান, আলম আদতে হুগলির বাসিন্দা। বছর কুড়ি ধরে সে দাসপুরের ভরতপুর গ্রামে বসবাস করছে। কাঠের ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে জমি-বাড়ি কেনাবেচা করত আলম। তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই ছেলে ভিন্ রাজ্যে থাকে। বাড়িতে আছেন তার স্ত্রী মমতা বিবি।
প্রতিমা ও আলমের যোগাযোগ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হল কী ভাবে?
পুলিশ জানাচ্ছে, দাসপুরেরই লাউদা গ্রামে প্রতিমার বাপের বাড়ি। বছরখানেক আগে প্রতিমার বোনের মেয়ের বিয়ের ঘটকালি করেছিল আলম। সেই সূত্রে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। প্রতিমা কলকাতায় থাকলেও দু’জনের মধ্যে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আলম এর আগেও কয়েক বার প্রতিমার গিরিশ পার্কের বাড়িতে এসেছে। এখানে সে কাঠের কাজও করেছে। তদন্তকারীরা বলছেন, যাতায়াতের সূত্রে প্রতিমার কয়েক জন প্রতিবেশী আলমের মুখ চিনতেন। তদন্তে নেমে ঘটনার দিন আলমের ওই বাড়িতে আসা এবং মোবাইলের সূত্র ধরে গোয়েন্দারা মোটামুটি নিশ্চিত হন, খুনের সঙ্গে আলমের যোগ আছে। তার ভিত্তিতেই মঙ্গলবার রাতে দাসপুরে হানা দেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। আলমের স্ত্রী মমতা বিবি এ দিন বলেন, ‘‘প্রতিমা বলে কাউকে চিনি না। তবে কাজ থাকলে আমার স্বামী কলকাতায় যেত। অনেক সময় রাতে ফিরত না।’’
গত শুক্রবার প্রতিমা বাপের বাড়ি থেকে কলকাতার বাড়িতে ফেরেন বলে জানান গোয়েন্দা-প্রধান। তার পরেই ওই মহিলা বাড়ির আসবাব ও বাসনকোসন বিক্রির জন্য আলমকে ডেকে পাঠান। প্রতিমা এই বাড়ি ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে ছোট ছেলের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন বলেও পুলিশ জানতে পেরেছে। পুলিশ জানায়, শনিবার আলম বেলা ২টো নাগাদ গিরিশ পার্কে আসে। তার পরে সেখান থেকে বেরিয়ে শিয়ালদহে কাঠের বাজারে যায়। রাত ৯টা নাগাদ ফের প্রতিমার ঘরে ঢোকে আলম।
ধৃতের বয়ান অনুযায়ী তার পরেই যৌন সংসর্গ, টাকা চেয়ে প্রতিমার হুমকি এবং পরিণামে খুনের ঘটনা ঘটে। লালবাজার সূত্রের খবর, আলম যে শনিবার প্রতিমার বাড়িতে ঢুকেছিল, স্থানীয় বাসিন্দাদের বয়ান থেকেই সেটা জানা যায়। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, প্রতিমা খুন হন রাত ১০টা নাগাদ। তা থেকেই সন্দেহ দৃঢ় হয় আলমের উপরে। এর পরে আলম ও প্রতিমার বচসার কথা জানতে পারেন তদন্তকারীরা। লালবাজারের দাবি, ঘটনার রাত পর্যন্ত আলমের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনও ছিল গিরিশ পার্ক এলাকা। গোয়েন্দা-প্রধান বলেন, ‘‘আলম খুন করে রাত ১০টা থেকে ২টোর মধ্যে গিরিশ পার্কের ওই বাড়ি ছেড়ে পালায়।’’
কী ভাবে এই তথ্য পেল পুলিশ?
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ওই বাড়ির এক বাসিন্দা শনিবার রাত ১০টা নাগাদ বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করেছিলেন। তিনি পুলিশকে জানান, তখন প্রতিমার ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছিল। ঘর ছিল ভিতর থেকে বন্ধ। রাত ২টো নাগাদ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ওই বাসিন্দা বাইরে এসে দেখেন, সদর দরজা খোলা। এই সূত্র থেকেই পুলিশ মনে করছে, রাত ১০টা থেকে ২টোর মধ্যে পালিয়েছিল আলম।এ দিন আলমকে ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়। তাকে ১৭ জুন পর্যন্ত পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। রাতেও আলমকে এক দফা জেরা করেন তদন্তকারীরা। প্রতিমার বাড়ির লোকেদের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলবেন বলে জানান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy