জাদুকর: বালিগঞ্জের বাড়িতে পি সি সরকার (জুনিয়র)। নিজস্ব চিত্র
টেবিলে থাকা রবারটা ডান হাতের আঙুল দিয়ে তুলে নিলেন। চকিতে সেটি বাঁ হাতের তালুতে চলে গেল। তার পরে ওই রবার মুখের ভিতরে পুরে নিলেন উল্টো দিকের চেয়ারে বসা মানুষটি। গিলে নিয়ে ঢেঁকুরও তুললেন!
তা হলে এ বার নিশ্চিত ওটা পেট থেকে বেরোবে?
প্রশ্নটা করতেই উল্টে আঁচড়ানো চুল আর পাকানো সরু গোঁফের মানুষটি ডান হাতের তালু খুলে দেখালেন, রবার রয়েছে যথাস্থানেই! বললেন, ‘‘এই যে অভিনয় করে মানুষকে বললাম, খেয়ে নিয়েছি। মানুষ সেটাই বিশ্বাস করলেন। আসলে টোটালটাই পলিটিক্স।’’
বাস্তবের রাজনীতিটাও তেমনই। এমনটাই বিশ্বাস করেন বালিগঞ্জের ‘ইন্দ্রজাল ভবন’-এর কর্তা প্রদীপচন্দ্র সরকার। সকলের কাছে যিনি জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র)। হেসে বললেন, ‘‘আসলে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। প্রাণী হলে অবশ্য আমার কথাটা বিশ্বাস করত না। রাজনীতিকেও মানুষ সে ভাবে বিশ্বাস করে নিচ্ছে। এ বোধহয় সত্যি কথা বলছে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
জাদুকর বাবার সাজানো-গোছানো ঘরে বসেই কথা বলছিলেন পাঁচ বছর আগের বারাসত লোকসভার বিজেপি প্রার্থী। ছেলেবেলায় অবশ্য ওই ঘরে ঢোকা বারণ ছিল তাঁর। কারণ, বাবা প্রতুলচন্দ্র সরকার বলতেন, ওই ঘরটা হল ‘ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিক’। বাবার কথা আজও মেনে চলেন। তবে এক সময়ে রাজনীতিতে মুখ দেখানো জাদুকর অবশ্য এটাও মনে করেন, ‘‘রাজনীতিতে কোনও ট্র্যাফিক নেই।’’
একই সঙ্গে তাঁর সহাস্য মন্তব্য, ‘‘মরে গিয়ে যখন বুড়ো ভূত হয়ে অন্য ভূতেদের সঙ্গে গপ্পো করব, তখন তো তারা জানতে চাইবে, ‘তুই ছিলি আর রাজনীতি করলি না?’ কী উত্তর দেব তখন?’’ ভোটে হারলেও উত্তর তৈরি প্রদীপচন্দ্রের। বললেন, ‘‘আমি ওদের বলব, যেটুকু সাধ্য করেছি। চেষ্টা করেছিলাম। কেউ তো আর দোষ দিতে পারবে না।’’ কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা কাটিয়ে ফের বললেন, ‘‘দেশটাকে খুব ভালবাসি। ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম মানে মন্ত্রী বা সাংসদ হতে চাইনি। বাবা স্টেজেই মারা গিয়েছিলেন। বাবার দেহটা বাড়িতে পাঠিয়ে, তাঁর পোশাক খুলে পরে নিয়ে শো করেছিলাম। সেই আমি রাজনীতি করব?’’
তা হলে ভোটে লড়লেন কেন?
‘‘দায়বদ্ধতা।’’ চোয়ালটা শক্ত করে মন্তব্য জুনিয়র পি সি সরকারের।
কীসের দায়বদ্ধতা?
উত্তর এল, ‘‘চোর, ডাকাত, সাধু, সন্ন্যাসী— সবাই তো ভোটে নামছে। তা হলে এক জন ভারতীয় হিসেবে আমিও নামতে পারি। ভোট দিলে দোষ নেই। ভোট নিলেই দোষ!’’ এক সময়ে প্রদীপচন্দ্র ভাবতেন, বিজেপি বোধহয় সম্পূর্ণ হিন্দুদের জায়গা। মুসলিমদের সেখানে কোনও জায়গা নেই। ভুলটা অবশ্য ভেঙেছিল বন্ধু এম জে আকবরের বিজেপি-তে যোগদানে। এর পরে ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা শোনার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন জাদুকর। বললেন, ‘‘বক্তৃতা শুনতে গেলাম। ওঁরা আমাকে একটা ভাল জায়গা দিলেন। যাতে ভিড়ে হারিয়ে না যাই। মোদীজির বক্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করল। পরে রাহুল সিংহ-সহ অনেকেই বাড়িতে এসে বললেন ওঁদের হাত ধরতে।’’
এ সবের পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টি-র ‘জনতা’ শব্দটা তাঁকে খুব টেনেছিল বলে দাবি করে জাদুসম্রাটের মন্তব্য, ‘‘জনতাই তো মাথা ফাটিয়ে আমার টিকিট কাটে। আমিও তো পর্দা খুলেই জনতাকে দেখি।’’ কিন্তু বারাসতের জনতা তাঁর হাত ধরলেন না কেন? সরু গোঁফের ফাঁক দিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘‘প্রচার করা বা দেওয়াল লেখা— কোনওটাই তেমন ছিল না আমার। আসলে নিজেও চাইনি, আমি জিতি। র্যালিতে বেরিয়ে আমার চেতনা হয়েছিল। কী প্রতিশ্রুতি দেব ওঁদের? সেটা পালন করব কী ভাবে?’’ আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের লড়াই নিয়ে তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘‘ওঁদের হয়তো অতিরিক্ত যোগ্যতা আছে।’’
গত লোকসভা নির্বাচনের পরে একটি অনুষ্ঠানে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জাদুকরের প্রশ্ন ছিল, ‘‘আমরা কবে বাঙালি প্রধানমন্ত্রী দেখব?’’ মমতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি কি এখনও বিজেপি-তে আছেন?’’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘আমি সব দলেই আছি।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোন বলে মানেন। দাদা হিসেবে তাঁকে রক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন। প্রদীপচন্দ্র বললেন, ‘‘বিজেপি-র প্রার্থী হয়েও বলেছিলাম, যাঁর মুরোদ আছে, তিনিই যেন জেতেন। মমতা ছাড়া এ রাজ্যে আর এক জনও শক্তিমান মানুষকে দেখান।’’ তবে ‘দু’হাজার উনিশ, বিজেপি ফিনিশ’ বলছেন না প্রদীপচন্দ্র। তাঁর স্বপ্ন, ‘‘সর্বভারতীয় স্তরে মোদী জিতুন, আর রাজ্যে মমতা জিতুন।’’
তাই জনতাকে বলতে চান, ‘‘যদি পি সি সরকারকে বিশ্বাস করেন, তা হলে আপনারা এ কথাটাও বিশ্বাস করুন। আর তাতেই ঘটবে ম্যাজিক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy