পরভূমে: পার্ক সার্কাসের দোকানে আব্দুল্লা। নিজস্ব চিত্র
বয়সের ভারে কোঁচকানো চোখ। ঘোলা কটা মণি। কুঁচকে যাওয়া সাদা শেরওয়ানিতে অযত্ন আছে, অবহেলা নেই। চওড়া হাতের পাঞ্জায় লড়াইয়ের তেজ। কিন্তু কোমর ভেঙে গিয়েছে। হাঁটার সময় বাঁ পায়ে ভর পড়ে বেশি। প্রায় ১৩ বছর আগে, বছর ষাটেক বয়সে ভাঙা কোমর নিয়ে প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন এই আফগান। অস্ত্রোপচারের পর ফিরে গিয়েছিলেন কাবুলে। কিন্তু ওই মাস কয়েকের মধ্যেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিলোত্তমা কলকাতার। সেই টানে ও চিকিৎসার প্রয়োজনে এর পর বার বার এ শহরে ফিরে এসেছেন আব্দুল্লা। শেষমেশ এখানেই খুলে ফেলেছেন আস্ত একটি আফগান রেস্তরাঁ।
পার্ক সার্কাস মোড়ের কাছে এই আফগান দোকান বহু দিনের। তবে বছর দুয়েক আগে মালিক বদলেছে। তার পর থেকেই পকেটের নাগালে আফগান খাবারের স্বাদ পেয়েছে কলকাতা। আব্দুল্লা এবং তাঁর ভাই দু’জনে মিলে চালাচ্ছেন ওই দোকান। থাকেন রেস্তরাঁতেই। দেশি ভাইদেরও থাকতে দেন। মালিক-শ্রমিক মিলে এক ঘরে রাতে ঘুমোন। বিকেলের নমাজের পরে দেশোয়ালি বন্ধুরা জড়ো হন রেস্তরাঁয়। আফগান-পাশতুন শব্দে গমগম করে ঘর। এত দিনে অবশ্য আব্দুল্লা বুঝে গিয়েছেন, আফগান স্বাদেই কলকাতার মন জিতে নিয়েছেন তিনি। ঠিক যে ভাবে প্রথম দর্শনে তাঁর মন জিতে নিয়েছিল কলকাতা।
সত্তরোর্ধ আব্দুল্লা অবশ্য স্বীকার করছেন, খাবারে যে আফগান স্বাদ তিনি আনতে চান, তা আসে না। আসবে কী করে? দু’দেশের আবহাওয়াই যে আলাদা! তবু তিনি কলকাতায় থাকতে চান। কারণ, এখানেই তিনি পেয়েছেন শান্তির খোঁজ। আব্দুল্লার কথায়, ‘‘এখানে নমাজের সময়ে মনঃসংযোগ করা যায়। সর্বক্ষণ বোমারু বিমানের শব্দের দিকে কান পেতে রাখতে হয় না। কাজে বেরনোর সময়ে শহরের মানুষ জানেন, দিনের শেষে বাড়ি ফিরবেন।’’ আফগানিস্তানে কয়েক দশকের যুদ্ধের আবহ বদলে দিয়েছে তাঁর মতো আরও অনেকের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি। তাই কলকাতায় ফিরলেই একই সঙ্গে মন ভাল এবং খারাপ হয়ে যায় তাঁর। মন খারাপ হয় দেশে থাকা পরিবারের কথা ভেবে। তাঁর চোখে কতটা তফাত এই দু’দেশে? আব্দুল্লা বলছেন, ‘‘তোমার আমার তফাত জমিন-আসমান। হাওয়ায়, মাটির গন্ধে, স্বাদে, রঙে, ভাবনায়। এখানে সূর্য ওঠে, আমার দেশের সূর্য বহু দিন যাবৎ বারুদ, ধোঁয়া আর ধসে যাওয়া বাড়ির ধুলোয় ঢাকা। তবু মুল্ক তো মুল্ক-ই! ইচ্ছে আছে রমজানের শেষে কাবুলে ফিরব।’’
কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছেন আব্দুল্লার ছেলে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, পড়াশোনার পর আমেরিকা বাদ দিয়ে অন্য যে কোনও দেশে চলে যেতে। আমেরিকার উপরে যে বড্ড রাগ আব্দুল্লার। ঠিক যতটা রাগ জলপাই উর্দির উপর। ওই উর্দির জন্যই যে তাঁর ঘর ভেঙেছে। মন ভেঙেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে শক্ত হয়েছে হাতের কব্জি। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান নিয়ে আব্দুল্লার আক্ষেপ, ‘‘আফগানরা লড়াইয়ের জাত নয়। আমাদের হাওয়া সুর আর কবিতার। আমার পরিবারেও অনেকে কবিতা লিখতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সব বদলে দিয়েছে।’’
পরিস্থিতি বদলাচ্ছে এ দেশেও। চারদিকে হিংসার আবহ। ১৩ বছর আগের ভারত কি এখনও দেখতে পান আব্দুল্লা? আলবাৎ পান। তিনি কাঠুয়া-কাণ্ডের নির্যাতিতার কথা জানেন, শোনেননি উন্নাওয়ের কথা। তবু তাঁর বিশ্বাস— ‘‘এ দেশে আমনের আবহ কোনও দিন কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। এখানে গণতন্ত্র আছে। এ দেশে এখনও দু’পক্ষের বন্দুকের নলের মুখে শান্তি বন্ধক রাখতে হয় না।’’ এ শহরকে ভালবেসেই কখনও এক গল্পে রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন আব্দুল্লা। চিনেছেন ছোট্ট মিনিকেও।
মিনির কলকাতায় রহমত এখন আব্দুল্লাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy