বিষাক্ত: যানবাহনের এই ধোঁয়া চিন্তা বাড়াচ্ছে শহরের। মঙ্গলবার, ধর্মতলায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শুধু বাতাসে ভাসমান ধূলিকণাই (পিএম ১০) নয়, পৃথক ভাবে সমস্ত মনিটরিং স্টেশনে মাপা হোক যানবাহনের ধোঁয়া থেকে তৈরি হওয়া দূষণও (নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড)। বিভিন্ন রাজ্যকে আগেই এই প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। এমনকি দূষণের মাত্রাবৃদ্ধিতে সতর্ক কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক দূষণের পরিস্থিতির উপরে নজর রাখার জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশজুড়ে ‘মনিটরিং নেটওয়ার্ক’ (জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলা ও শহর জুড়ে মনিটরিং স্টেশন) তৈরি করার কথাও বলেছে।
কিন্তু নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড মাপার প্রস্তাবে গোড়াতেই বেঁকে বসে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যুক্তি, গত দু’বছর ধরে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তা পরিমাপ করে অর্থ ও সময় ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজ ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই) প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গেল, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, মুম্বই-সহ সব মেগাসিটির মধ্যে একমাত্র দিল্লি ও কলকাতাতেই নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের স্বাভাবিক মাত্রা (বার্ষিক প্রতি ঘনমিটারে ৪০ মাইক্রোগ্রাম) গত সাত বছরে ধারাবাহিক ভাবে বেশি থেকেছে।
যেমন এ দিন সকাল ৯টাতেই রবীন্দ্রভারতী এলাকায় নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ছিল ১২১.৭৬ ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে এর মাত্রা ছিল ১৩০.৯২। এই মুহূর্তে কলকাতার দু’টি স্টেশনে, বি টি রোডস্থিত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে অন্য দূষকের পাশাপাশি নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড পরিমাপ করে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কিন্তু সবক’টি স্টেশনেই কেন্দ্র তা করতে বলায় বেঁকে বসে রাজ্য। এ দিনের আলোচনাসভার অন্যতম বক্তা সিএসই-র এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি) অনুমিতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘দিল্লি, কানপুরের পাশাপাশি নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের নতুন হটস্পট হল কলকাতা!’’
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’-এর রিপোর্টে গত পাঁচ বছর ধরে বায়ুসূচকের স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়ানোর জন্য সারা দেশের যে ১০২টি শহরকে ‘নন অ্যাটেনমেন্ট সিটি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল কলকাতা। অনুমিতার কথায়, ‘‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রামে ২০২৪ সালের মধ্যে সারা দেশেই দূষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ২০-৩০ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে কলকাতার দূষণের যা পরিস্থিতি এই মুহূর্তে, তাতে এখানে দুষণ ৪৮-৪৯ শতাংশ কমাতে হবে।’’
কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, এক দিকে সারা দেশ জুড়ে গাড়ির অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি। সিএসই-র রিপোর্টই বলছে, দেশে ১৯৫১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট যান (ভেহিকল) রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ৭০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ছয় দশকে, অর্থাৎ ২০০৮ সাল পর্যন্ত যানের সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৫৩ লক্ষ। আর তার পরের আট বছরে, অত অল্প সময়ে আরও সাড়ে ১১ কোটি যান নথিভুক্ত হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার ক্ষেত্রে প্রথম এক কোটির মাত্রা ছুঁতে সময় লেগেছে প্রথম ৫৫ বছর, আর পরের ১০ বছরে ব্যক্তিগত গাড়ি নথিভুক্ত হয়েছে দু’কোটি! অর্থাৎ, আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে যান-বিস্ফোরণ! কলকাতাও ব্যতিক্রম নয় এই যান-বিস্ফোরণের চিত্রে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে কলকাতা দূষণের সার্বিক চিত্র নিয়ে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিয়েছে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)। সেই রিপোর্টেও শহরের দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে যানবাহনের ধোঁয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। মুম্বইয়ের মতো কলকাতায় যদিও গণপরিবহণের সংখ্যা বেশি, যা অন্য মেগা সিটির তুলনায় কিছুটা হলেও কলকাতাকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা পুরনো যানবাহনের সংখ্যা। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘কলকাতা তো পুরনো গাড়ির বৃদ্ধাশ্রম! যানজট, স্বল্প পরিসর রাস্তায় অত্যধিক গাড়ি, ধোঁয়া পরীক্ষা কেন্দ্রগুলি সঠিক ভাবে কাজ করে না। বায়ুদূষণ নিয়ে পরবর্তী শুনানি সেই ১৬ জুলাই, তত দিন যানবাহনের ধোঁয়া হজম করতে হবে আমাদের।’’
এদিন নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পাশাপাশি পিএম১০-সহ অন্য দূষক নিয়েও আলোচনা হয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, দূষণের যা পরিস্থিতি তাতে পিএম১০ বা পিএম২.৫ (অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা) শুধু নয়, এবার পিএম১ (অর্থাৎ আরও সূক্ষ্ম ধূলিকণা) পরিমাপ করতে হতে পারে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজি-র ডিরেক্টর গুফরান বেগ বলেন, ‘‘জৈব জ্বালানিও কলকাতার দূষণের অন্যতম কারণ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy