আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ভেঙে পড়ার মহাবিপদ থেকে বরাতজোরে রেহাই পেল কলকাতা। রক্ষা পেলেন তিনটি বিমানের চার শতাধিক যাত্রী।
তিনটি বিমানের মধ্যে দু’টি নেমে আসছিল কলকাতায়। আর একটি সেই সবে উড়েছে কলকাতা থেকে। হঠাৎ তিন বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় কলকাতা বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা এটিসি-র। দু’-এক মিনিট নয়, দীর্ঘ ১১ মিনিট তিন বিমানের পাইলটদের সঙ্গে এটিসি অফিসারেরা কার্যত কোনও কথাই বলতে পারেননি। এটিসি-র নির্দেশের অভাবে তিন পাইলটেরই দশা তখন মাঝসমুদ্রে হাল ভেঙে দিশা হারানো নাবিকের মতো। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ওই সময়ে নামতে তৈরি দু’টি বিমানের একটির সঙ্গে বা দু’টিরই সঙ্গে সদ্য ওড়া তৃতীয় বিমানের সংঘর্ষ ঘটতে পারত। আর আকাশ ভেঙে পড়ত কলকাতায়!
ঠিক কী ঘটেছিল?
বিমানবন্দরের খবর, প্রায় ১৫০ জন যাত্রী নিয়ে তখন কলকাতা থেকে সবে উড়েছিল গো এয়ারের দিল্লিগামী বিমান। শুক্রবার সকাল তখন ৯টা ১৭ মিনিট। পাঁচ হাজার ফুট উপরে ওঠার পরে আচমকাই সেই বিমানের পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এটিসি-র। মাথায় হাত পড়ে এটিসি অফিসারদের। যে-রেডিও কম্পাঙ্কের মাধ্যমে পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছিল, আচমকাই তা বিকল হয়ে যায়। এ বার কী হবে?
ওই অবস্থায় বিমান নিয়ে পাইলটের হুহু করে উপরে উঠে যাওয়ার কথা। ককপিটের সামনে কিছুই দেখা যায় না। পাইলটকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় এটিসি অফিসারদের উপরে। এটিসি অফিসারেরা বিমানবন্দরের মনিটরে সব বিমানের গতিবিধি দেখতে পান। সেই গতিবিধি অনুযায়ী পাইলটকে বলেন, কোন দিকে যেতে হবে। কখন কত উচ্চতায় উঠতে হবে। কোথায় কোথায় অন্য বিমান আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। গো এয়ারের পাইলটকে কী ভাবে পথ দেখাবে এটিসি? আতান্তরে পড়ে যান পাইলটও।
বিপদের উপরে আরও বিপদ ঘনিয়ে আসে নামতে তৈরি অন্য দু’টি বিমানকে ঘিরে। আচমকাই দেখা যায়, কলকাতায় নামার জন্য মহানগরের মাথার উপরে চলে এসেছে জোড়া বিমান। দু’টিই জেট এয়ারওয়েজের। একটি এসেছে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। অন্যটি দিল্লি থেকে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসা বিমানটি তত ক্ষণে নেমে এসেছে সাত হাজার ফুট উচ্চতায়।
এবং সে এসে পড়েছে কলকাতা থেকে ছেড়ে যাওয়া গো এয়ার বিমানের প্রায় ঘাড়ের উপরে! দিল্লি থেকে আসা বিমানটি তখন আট হাজার ফুট উপরে। নামতে থাকা দু’টি বিমানের সঙ্গেও তত ক্ষণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এটিসি-র। দেখা যায়, অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া অন্যান্য বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় নামতে তৈরি আর এখান থেকে সদ্য ওড়া বিমানের সঙ্গেই যোগাযোগ হচ্ছে না। কাজ করছে না তিনটি রেডিও কম্পাঙ্ক। ওই তিন কম্পাঙ্কের মাধ্যমেই তিনটি বিমানকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা এটিসি-র। এই পরিস্থিতি কী ভাবে সামলাবেন, ভেবে ঘাম ছুটে যায় এটিসি অফিসারদের।
কী ভাবে বিপদ ঘটতে পারত?
বিমান-বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এটিসি-র কোনও নির্দেশ না-পেয়ে গো এয়ারের বিমান সটান উপরে উঠে গেলে প্রথমেই ধাক্কা লাগতে পারত পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসা জেটের বিমানের সঙ্গে। তত ক্ষণে জেটের ওই বিমানের আরও নীচে নেমে আসার কথা। এক হাজার ফুট উঠতে বা নামতে একটি বিমান মেরেকেটে এক থেকে দেড় মিনিট নেয়। ফলে যে-কোনও মুহূর্তেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসা বিমান যদি কোনও ভাবে পাশ কাটিয়ে যেত, তা হলেও বিপদ পিছু ছাড়ত না। তখন দিল্লি থেকে আসা জেটের বিমান পড়তে পারত গো এয়ারের ঊর্ধ্বমুখী বিমানের সামনে। এবং সে-ক্ষেত্রেও সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল ষোলো আনা।
জোড়া সংঘর্ষের আশঙ্কার মুখে এটিসি অফিসারেরা একটি জরুরি কম্পাঙ্ক মারফত যোগাযোগের চেষ্টা চালাতে থাকেন। চার মিনিটের চেষ্টায় সেই কম্পাঙ্কের সাহায্যে প্রথমে যোগাযোগ করা হয় গো এয়ারের পাইলটের সঙ্গে। তত ক্ষণে গতি কমিয়ে সেই বিমান ছ’হাজার ফুটে উঠেছে। বিমানবন্দরের এক অফিসার বললেন, ‘‘মাটি ছেড়ে ওঠার সময়ে অত ভারী একটি বিমান গতি কমিয়ে দিলেও বিপদ হতে পারে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে পাইলটের আর বোধ হয় কিছুই করার ছিল না।’’
রক্ষা পাওয়া গেল কী ভাবে?
সুরাহার পথ খুঁজতে খুঁজতে একটি জরুরি কম্পাঙ্কের মাধ্যমে মাত্র এক বারই মুহূর্তের জন্য গো এয়ারের পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এটিসি-র। তখনই ওই পাইলটকে বলে দেওয়া হয়, তিনি যেন ছ’হাজার ফুটেই উড়তে থাকতেন। পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত তিনি যেন আর মোটেই উপরে না-ওঠেন। জরুরি কম্পাঙ্কের সাহায্যে জেটের জোড়া বিমানের সঙ্গেও হঠাৎ যোগাযোগ হয়ে যায়। এটিসি ওই দু’টি বিমানের পাইলটদেরও নির্দেশ দেয়, তাঁরা যে-উচ্চতায় রয়েছেন, সেখানেই যেন উড়তে থাকেন। আপাতত উচ্চতার যেন কোনও রকম হেরফের না-হয়।
আর কলকাতা থেকে ওড়ার জন্য প্রস্তুত অন্যান্য বিমানকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখনই ওড়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে। মনিটরে যে-সব বিমানকে দূর থেকে কলকাতার দিকে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছিল, তাদের গতি কমিয়ে দু’টি বিমানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন এটিসি অফিসারেরা। যাতে দূরের বিমানগুলির কলকাতায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগে। তা হলে কম্পাঙ্ক-বিভ্রাট সারিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
বিমানবন্দরের এক কর্তার কথায়, ‘‘যে-ক্ষিপ্রতায় এটিসি অফিসারেরা এ দিন পরিস্থিতি সামলেছেন, তার কোনও তুলনাই হয় না। তাঁদের তরফে ওই বিচক্ষণ তৎপরতা না-থাকলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।’’
বিকল তিনটি রেডিও কম্পাঙ্ক আবার কাজ শুরু করে সকাল ৯টা ২৮ মিনিটে। যাঁরা ভারতের আকাশ নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এর তরফে এ দিনের ঘটনার সবিস্তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ডিজিসিএ সূত্রের খবর, যান্ত্রিক ত্রুটি, নাকি কোনও মানুষের ভুলে এমন গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। বিমানবন্দরের রিজিওনাল এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর শুদ্ধসত্ত্ব ভাদুড়ী অবশ্য বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি জানান, একটা এমন ঘটনা ঘটেছে ঠিকই। তবে সেটা এমন কিছু গুরুতর ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy