আমেরিকার এক পুলিশকর্তার মৃত্যুতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সংবাদপত্রে সেই ঘটনার খবর (ডানদিকে)।
এলাকায় দিনের পর দিন ডাকাতির ঘটনা ঘটছিল। অভিযোগ, পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও ডাকাতি থামেনি। শেষ পর্যন্ত ডাকাতেরা এক জায়গায় রয়েছে, এমন খবর পেয়ে সেখানে চড়াও হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তার পরে দল বেঁধে তাঁরাই পিটিয়ে মেরেছিলেন ডাকাতদের।
পুলিশকর্তার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ক্ষোভ জন্মেছিল। সকলে মিলে পরিকল্পনা করেছিলেন, কী ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় অভিযুক্তকে। শেষ পর্যন্ত মুখে কাপড় বেঁধে জনা পঞ্চাশ ব্যক্তি জেলের মধ্যে ঢুকে টেনেহিঁচড়ে বার করে এনেছিলেন অভিযুক্তকে। তার পরে সকলে মিলে তাকে টানতে টানতে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে একটি পাইন গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রথম ঘটনাটি বারুইপুর এলাকার, বছর কুড়ি আগের। দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রায় ৮৫ বছর আগের, আমেরিকার।
গণপিটুনির ক্ষেত্রে ক্ষোভ-রোষ-হিংসা এ ভাবেই সময় ও স্থান বিশেষে অবিকৃত থেকেছে বরাবর। জানাচ্ছেন গবেষক ও সমাজবিদেরা। তাঁদের মতে, মানচিত্রে ঘটনাস্থলের শুধু পরিবর্তন ঘটছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে চলতি মাসের শুরুতে হাওড়ায় কিংবা বুধবার লেকটাউনে গণপিটুনির ঘটনা। কিন্তু হিংস্রতার তীব্রতা মাত্রাভেদে তা শুধু উনিশ-বিশ!
আরও পড়ুন: মারধরে অভিযুক্তদের ধরতে ‘ঢিলেমি’ কেন
গণপিটুনিতে মৃত্যুর বীভৎসতা সম্পর্কে সচেতন করতে আমেরিকায় ‘উইদাউট স্যাঙ্কচুয়ারি’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়েছিল। পরে এই নামে ওয়েবসাইটও চালু হয়েছে। কয়েক দশক ধরে গণপিটুনিতে মৃত্যুর তথ্য ও ছবি একত্রিত করে তা সেখানে দেওয়া হয়েছে। ওই সাইটে গিয়ে কেউ ক্লিক করলেই প্রায় আট দশক আগেকার গণপিটুনিতে মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও জানতে পারবেন।
‘‘আমাদের দেশে এমনটা হওয়া খুব একটা সম্ভব বলে মনে করি না। কারণ, এর জন্য সুশীল সমাজের খুব সক্রিয় ও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। এখানে কোনও ঘটনা নিয়ে কিছু দিন আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তবে কিছু হয় না,’’ বলছেন গবেষক-সমাজতত্ত্বের শিক্ষক শমিত কর। শমিতবাবু গণপিটুনি ও তাতে মৃত্যুর উপরে দীর্ঘ কয়েক বছর গবেষণা করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশকে বলে লাভ নেই, এমন মানসিকতা থেকেই গণপিটুনির ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে।’’
আরও পড়ুন: সেতুভঙ্গে শেষ হয়নি তদন্ত, পদোন্নতি ইঞ্জিনিয়ারের
প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় অবশ্য গণপিটুনির কারণ হিসেবে পুলিশের প্রতি অনাস্থার বিষয়টি মানতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তো থানার সংখ্যা বেড়েছে। ফলে পুলিশের প্রতি অনাস্থার যুক্তি আর খাটে না। আসল কথা হল, সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে।’’
অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। তাই পুরো ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানেন না, এমন লোকজনও গণপিটুনিতে যোগ দিচ্ছেন। কোথাও হয়তো চোর সন্দেহে কাউকে মারধর চলছে। সে সময়ে পাশের রাস্তা থেকে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। তিনি কিছু না জেনেশুনেই ওই মারধরে নেমে পড়লেন। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘সম্প্রতি এন আর এসে দু’জন কয়েকটি কুকুরছানাকে পিটিয়ে মেরেছে। ভয়াবহ নৃশংসতা। আবার ওই দু’জনকেও অনেকে পিটিয়ে মেরে ফেলার কথা বলেছেন। গণপিটুনির বীজ কিন্তু সব পক্ষের মধ্যেই রয়েছে।’’
সেই বীজই অঙ্কুরিত হচ্ছে অনেকের সংসর্গে এসে। ‘হাতের সুখ’ করার ইচ্ছে রয়েছে প্রবল, অথচ সাহসে কুলোচ্ছে না। তাই দল বেঁধে গণপিটুনি। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘সকলে মিলে মারলে ঘটনার দায় কারও একার থাকে না। ‘অ্যানোনিমাস’ হয়ে যায় পুরো বিষয়টাই।’’
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো আলাদা করে এত দিন গণপিটুনি বা তাতে মৃত্যুর হিসেব উল্লেখ করত না। তবে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি দেখে আগামী দিনে এ সংক্রান্ত তথ্য আলাদা ভাবে প্রকাশ করা হবে বলে এনসিআরবি সূত্রের খবর।
গণপিটুনি সংক্রান্ত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন গবেষক-সমাজবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বেশির ভাগ গণপিটুনির শিকারই হল ছিঁচকে চোর বা তেমন কেউ। ডাকাত বা দাগি অপরাধীদের পিটিয়ে মারা হয়েছে, এমন সংখ্যা হাতে গোনা। শমিতবাবুর কথায়, ‘‘ডাকাতদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র বা ভোজালি থাকতে পারে। পাল্টা আঘাত আসতে পারে। তাই দুর্বল কাউকে মারো, মেরে হাতের সুখ করে নাও। এখানেও আসলে ক্ষমতার বৈষম্য। এক সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদেরও তো মারা হত এ ভাবেই।’’
সেই ‘হাতের সুখ’-এ মিলে যাচ্ছে হাওড়া-লেকটাউন। মিলে যাচ্ছে ১৯৩৫ ও ২০১৯ সাল। ‘হাতের সুখ’-এর মানচিত্র ক্রমশ বাড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy