Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

বারবার গর্ত, তবু হেলদোল নেই পুরসভার

কেউ বলছেন, নিকাশি পাইপলাইন নষ্ট হয়েছে। কেউ বলছেন, কোনও কারণে সরে গিয়েছে ভূগর্ভের মাটির স্তর। কারও মনে হয়েছে, অবৈধ নির্মাণের জের। আবার ঠিকমতো পিচের আস্তরণ না দেওয়াকে দায়ী করেছেন অনেকে। ইঁদুরের ঘাড়ে দায় চাপানোর লোকও রয়েছে বিস্তর। মাত্র এক মাসের মধ্যে মহানগরীতে সাত জায়গায় প্রধান সড়কে ধস নামার পিছনে এমন বিবিধ কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারেরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৪৪
Share: Save:

কেউ বলছেন, নিকাশি পাইপলাইন নষ্ট হয়েছে। কেউ বলছেন, কোনও কারণে সরে গিয়েছে ভূগর্ভের মাটির স্তর। কারও মনে হয়েছে, অবৈধ নির্মাণের জের। আবার ঠিকমতো পিচের আস্তরণ না দেওয়াকে দায়ী করেছেন অনেকে। ইঁদুরের ঘাড়ে দায় চাপানোর লোকও রয়েছে বিস্তর।

মাত্র এক মাসের মধ্যে মহানগরীতে সাত জায়গায় প্রধান সড়কে ধস নামার পিছনে এমন বিবিধ কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারেরা। কিন্তু রাস্তা ধসে পড়লে যাদের সব থেকে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা, সেই কলকাতা পুরসভার কিন্তু হেলদোল চোখে পড়ছে না। রাস্তা বিশেষজ্ঞদের অনেকে যখন বিশদ সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন, সেখানে পুরসভা একটি ঘটনার সঙ্গে অন্যটির মিল খুঁজতে নারাজ।

প্রবীণ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নীতিন সোমের মতে, “মাটির নীচে নিকাশি পাইপলাইন নষ্ট হলে রাস্তায় ধস নামতেই পারে। তা ছাড়া কাঠামোর তলা থেকে মাটি সরে গেলেও ধস নামে। পাশাপাশি, ধসের এলাকায় নির্মাণকাজ বাড়ছে কি না, তা-ও দেখা দরকার।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন প্রধান নীতিনবাবু জানাচ্ছেন, মাটির তলার পুরনো ইটের কাঠামো ভেঙে গেলেও ধস নামতে পারে।

দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক অলোক সরকারের মনে হয়েছে, কলকাতার প্রধান সড়কগুলির উপরে যে পিচের আস্তরণ দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি নিয়ম মেনে হয় না। এর ফলে পিচের আস্তরণের মধ্যে ফাঁক থেকে যায়। সেই ফাঁক দিয়ে জল গলে পুরো কাঠামোই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অলোকবাবু বলেন, “পিচ ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলানোর নিয়ম। ওই তাপমাত্রায় পিচ গললে পিচের আস্তরণ মসৃণ হয়। গাড়ির চাপে পিচের আস্তরণের চিড় ধরে না। চিড় ধরলেই বিপদ। সেখান দিয়ে জল চুঁইয়ে ঢুকে পড়বে ভিতরে।” কিন্তু কলকাতার কোথাও ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পিচ গলাতে তিনি দেখেননি বলে দাবি অলোকবাবুর।

পূর্ত দফতর এবং কলকাতা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরা অনেকেই দায় চাপিয়েছেন ইঁদুরের উপরে। তাঁরা বলছেন, ইঁদুর নিজেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ছে। সেই গর্তের জন্যই ধস নামছে এখানে ওখানে। যে সাত জায়গায় গত কয়েকদিনে ধস নেমেছে তার মধ্যে অন্তত তিনটি মেট্রো স্টেশনের লাগোয়া (শ্যামবাজার, শোভাবাজার এবং সেন্ট্রাল)। এই জন্য রেলের জন্যও ভবিষ্যতে বিপদ ডেকে আনতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নীতিনবাবু বলেন, “ইঁদুরের জন্য ধস নামার কথা শুনেছি, কিন্তু কোথায় ইঁদুরের উৎপাত বেশি, কতটা জায়গা জুড়ে তাদের সাম্রাজ্য, সে সব না জেনে তা বলা শক্ত।”

শহরের রাস্তায় ধস নামার অন্য একটি কারণ তুলে ধরেছেন পুরসভার নিকাশি বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার অমিত রায়। এ দিন তিনি বলেন, শহরে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি ম্যানহোল রয়েছে। যা বহু পুরনো। তার নীচে ইটের কাঠামো ভেঙে পড়লে সাময়িক ভাবে গর্ত হয়। মঙ্গলবার আমহার্স্ট স্ট্রিটের ধসের কারণও কি তবে তাই? অমিতবাবু বলেন, “ওখানে একটা পাম্পিং স্টেশন রয়েছে। যা ইটের কাঠামোর কাছেই। ওই কাঠামো থেকে দুটো ইট ভেঙে যেতেই ওই বিপত্তি।” যার ফলে নিকাশি পাইপ ভেঙে গিয়ে জলও বেরচ্ছে বলে পুর সূত্রে জানা গিয়েছে।

পুরসভা সূত্রের খবর, শহরে মাটির নীচে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার ইটের কাঠামো আছে। যা ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। নিকাশি পরিকাঠামোর উন্নয়নে কিছু এলাকায় জিআরপি লাইনার বসানো হয়েছে। বাকি এলাকায় পুরনো ইটের কাঠামোই রয়ে গিয়েছে। সে সব কাঠামো যে নড়বড়ে তা অনেক আগেই পুর প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে একাধিক বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা। কিন্তু তার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা এখনও করতে পারেনি পুর প্রশাসন। তাই শহরে ধসের ঘটনা যে আরও বাড়বে তা জানিয়ে দিয়েছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। তা নিয়ে অবশ্য এখনও কোনও হেলদোল নেই পুরকর্তাদের।

নীতিনবাবুদের বক্তব্য, “নিয়মিত ভাবে রাস্তার নীচের হাল দেখার পাশাপাশি পুরনো আমলে গড়ে ওঠা ইটের কাঠামো পরীক্ষা করে দেখা দরকার। আর এ কাজের দায়িত্ব পুরসভাকেই নিতে হবে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE