ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
বালিগঞ্জের আইস স্কেটিং রিঙ্কের উল্টো দিকে নদিয়া হাউস। তার সামনে ব্রাইট স্ট্রিটের ফুটপাথ জুড়ে রয়েছে খান পনেরো খাবারের দোকান। ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ থেকে শুরু করে চাউমিন-রোল, কিছুই বাদ নেই। রয়েছে চা-বিস্কুটের দোকানও। রীতিমতো বাঁশের কাঠামোর ওপর ছাউনি বেঁধে পাকাপাকি দোকান খাড়া করা। পাকা উনুনের পাশে ঢালাও পাতা চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি। এক চিলতে জায়গায়ও খালি নেই ফুটপাথে। বেলা বারোটা থেকেই থিকথিক করে ভিড়। বেকবাগান এলাকার অফিসকর্মী থেকে গাড়িচালক, সকলের মধ্যাহ্নভোজনের ঠেক হয়ে ওঠে ওই ফুটপাথই।
এই ফুটপাথেরই একটি বড়সড় হোটেলের মালিক আবিদ হুসেন। ২২ বছর আগে শুরু করেছিলেন ছোট করে। ক্রমে বড় হয় দোকান। পাশাপাশি আরও অনেকে ব্যবসা শুরু করেন। আবিদের দোকানের কর্মী ঝন্টু প্রামাণিক জানালেন, দোকান চালান তিনি। মালিককে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে দেন। মালিক আবিদ হুসেন বললেন, ‘‘প্রতি মাসে ৪০০-৪৫০ টাকা দিয়ে দিই পুলিশকে, ব্যস আর কোনও ঝামেলা নেই।’’ আর উৎখাত হওয়ার ভয়? ছোট্ট জবাব— ‘‘আবার বসব।’’ কথা বলে জানা গেল, আট-ন’বছর আগে বামফ্রন্টের আমলে একাধিক বার খালি করে দেওয়া হয়েছে ফুটপাথ। কিন্তু ওই কয়েক দিনের জন্যই। তার পর ফের খুলেছে দোকান।
পুরসভা কিছু বলে না? বা স্থানীয় প্রশাসন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানমালিকের কথায়, ‘‘আমরা তো চাই পুরসভার তরফে আমাদের কাছে আসুক, ‘সেটিং’ করে নেব। যেটুকু ভয় আছে, সেটুকুও থাকবে না।’’ আর স্থানীয় প্রশাসনের তরফে কোনও বাধা দূরের কথা, আগ্রহও দেখানো হয় না। দোকান-মালিকদের দাবি, বাম আমলে তবু কিছু চাঁদা চাওয়া হতো, মিটিং মিছিলে লোক দিতে বলা হতো। এখন তো সেটুকুও পরোয়া করতে হয় না।
যদি কখনও উঠে যেতে হয়, সে কথা ভেবে তাই কোনও ভয়ই নেই আবিদদের। নিস্পৃহ ভাবে বলেন, ‘‘এ সব উচ্ছেদ-উৎখাত দু’দিনের হুজুগে হয়। লোকের খিদে চিরকাল থাকবে, সস্তায় খাবার খুঁজতেও আমাদেরই প্রয়োজন হবে।’’ আর এ সব কিছুর উপরে তো শাসক দলের প্রচ্ছন্ন মদত আছেই। আছে পুলিশকে নিয়মিত তোলা দেওয়ার ভরসাও।
ছবিটা খুব একটা আলাদা নয় রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডেও। ওয়েলেসলির ওই চত্বরে একসঙ্গে ঝাঁকবাঁধা দোকান না থাকলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় খান পঞ্চাশ খাবারের দোকান আছে গোটা রাস্তার ফুটপাথে। কোনওটা আংশিক, কোনওটা সম্পূর্ণ ভাবে ফুটপাথের দখলদারি নিয়েছে। পনেরো বছরের পুরনো ভাত-রুটির হোটেলের মালিক আফাক আহমেদ বললেন, তিনি স্থানীয় বাসিন্দা। পনেরো বছর বয়স থেকে কাজে লেগেছিলেন, এখন দোকানের মালিক। সপ্তাহে ৫০ টাকা করে পুলিশকে তোলা দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন এত দিন ধরে। সেই নিশ্চিন্তির নিঃশ্বাস ফেলেই বলেন, ‘‘তৃণমূল করি আমরা সবাই। হঠাৎ করে কিছু হবে না।’’
এলাকায় যতগুলি খাবারের দোকান, তার বেশির ভাগেরই মালিক স্থানীয়েরাই। দীর্ঘ দিন ধরে ফাঁকা, চওড়া ফুটপাথে ব্যবসা করছেন তাঁরা। একটি রোল-চাউমিনের দোকানের মালিক জানালেন, বাম আমলে দুয়েক বার ফুটপাথ খালি করার জন্য দোকান উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর সে সব সমস্যা নেই। বরং কাজ চেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ হলে ফুটপাথেই দোকান খোলার পরামর্শ দেওয়া হয়। শুধু পরামর্শ নয়, ‘‘তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই রাস্তায় ৮০% হকার বেড়েছে।’’— বক্তব্য এক দোকান মালিকের।
আফাক আহমেদ জানালেন, এলাকার প্রত্যেকের হকার কার্ড আছে। নিয়মিত রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে থাকেন তাঁরা। আছে নিজেদের ইউনিয়নও। হঠাৎ বিপদ এলে, বা উঠে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এলে একজোট হয়ে লড়বেন। প্রয়োজনে আন্দোলনের পথে যাবেন। তবে এ সব করে যদি লাভ না হয়? ‘‘এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাবে।’’— নিস্পৃহ জবাব আফাকের।
এলাকার কাউন্সিলর সন্দীপন সাহাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর বক্তব্য, ‘‘নতুন হকারের বসার অভিযোগ সত্যি নয়। আমার এলাকায় গত পাঁচ বছরে এক জনও নতুন ব্যবসা শুরু করেননি ফুটপাথে।’’ তিনি জানালেন, সম্প্রতি শহর জুড়ে রাস্তা চওড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বহু জায়গায় ফুটপাথ সরু করতে হবে সেই জন্য। রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে তা করতে গিয়ে যে সব হকারকে উঠে যেতে হবে, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁর কথায় ‘‘উন্নয়নের স্বার্থে মানবিকতা বিসর্জন দিতে রাজি নয় আমাদের সরকার। এত দিনের আর্থ-সামাজিক গঠনকে অস্বীকার করে উন্নয়ন হয় না। দোকানগুলির মাধ্যমে যেমন বহু পরিবারের খাদ্যসংস্থান হয়, তেমনই বহু মানুষ দু’বেলা সস্তায় পেট ভরান দোকানগুলি থেকেই। সবটা এক দিনে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy