Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

মরণাপন্ন ক্যানসার রোগীদের ঘরেই যত্ন নিখরচায়

জীবন অস্তগামী তাঁদের। টেনেটুনে বড়জোর আর ২-৮ মাস। তার বেশি আশা দিচ্ছেন না চিকিৎসকেরা। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘টার্মিনাল কেস’।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:৪৬
Share: Save:

জীবন অস্তগামী তাঁদের। টেনেটুনে বড়জোর আর ২-৮ মাস। তার বেশি আশা দিচ্ছেন না চিকিৎসকেরা। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘টার্মিনাল কেস’।

চিকিৎসকদের কথায়, মৃত্যুপথযাত্রী এই রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা বা টানাহ্যাঁচড়া করা অযৌক্তিক। তার চেয়ে দরকার বাড়িতেই পরিচর্যা, সহযোগী চিকিৎসা, ভালবাসা আর যত্ন, যাকে বলা হয় ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’। তার জন্যই ওই রোগীদের অপরিচিত, অনাত্মীয় কিছু মানুষ একজোট হয়েছেন স্রেফ মানবিকতার তাগিদে।

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সহযোগিতায় ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়া প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ এবং ‘কোশিশ’ নামে দু’টি সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মিলে শুরু করতে চলেছে একটি পরিকল্পনা। মৃত্যুর আগের কয়েকটা মাস যাতে বাড়িতে রেখেই ‘টার্মিন্যাল’ ক্যানসার রোগীদের পরিচর্যা করা যায়, তা-ই লক্ষ্য। সরকারি হাসপাতালে মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত রোগীদের নিখরচায় ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’-এর আওতায় আনার এটাই প্রথম প্রচেষ্টা। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এটাও এক ধরনের পিপিপি (প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ) মডেল। কিন্তু এর মধ্যে টাকাপয়সার ব্যাপার নেই। সরকারি হাসপাতাল থেকে এমন রোগী সংগ্রহে সাহায্যের কাজটা সরকার করে দেবে। বাকি দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবীদের।’’ আগামী এক বছরের মধ্যে রাজ্যের সব ক’টি মেডিক্যাল কলেজে এই প্রচেষ্টা ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।

কী ভাবে রূপায়িত হচ্ছে পরিকল্পনা?

আর জি কর, এন আর এস এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের পাশেই রবিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিন সকাল ন’টা থেকে দু’টো পর্যন্ত চলছে ‘হেল্প কিয়স্ক’। ক্যানসার বিভাগের আউটডোরে প্রতি দিন যত রোগী আসছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে বাছাই করে কিছু রোগীর আলাদা তালিকা তৈরি করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

সংস্থার তরফে শঙ্খশুভ্র মিত্র ও দেবতীর্থা দত্ত জানালেন, আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, বয়স্ক এবং দেখার লোক নেই, এমন ক্যানসার রোগীদেরই প্রধানত বাছা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিঃসন্তান বা ছেলেমেয়ে বাইরে থাকেন বা মারা গিয়েছেন বা যোগাযোগ রাখেন না, এমন বয়স্ক রোগীরা অগ্রাধিকার পান। আত্মীয়স্বজন কম, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বৃদ্ধ-অসুস্থ এবং তাঁদের এক জন ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে, এমন রোগীদেরও বেছে নেওয়া হয়।

পরিচর্যার অংশটা দেখে দ্বিতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এর সদস্যেরা কেউ গৃহবধূ, কেউ ক্যানসার জয় করে জীবনে ফিরেছেন, কেউ ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী বা আর্থিক উপদেষ্টা। শিবানী দেব, ধীরা বসু, রুণা মিত্র, নমিতা চক্রবর্তী, নীলাঞ্জনা দে, অভিজিৎ দাম, অনিমেষ সেনদের মতো অনেকে নিজেদের কাজ, সংসার ও দায়িত্ব সামলে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে একাধিক দলে ভাগ হয়ে ব্যাগ ভর্তি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যান ওই রোগীদের বাড়ি। প্রতি দলে অন্তত এক জন করে চিকিৎসক থাকেন।

ধীরা, শিবানী, অভিজিৎদের কথায়, সরকারি হাসপাতালে এই রোগীদের রাখা মানে অযথা একটি শয্যা আটকে রাখা। আর বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু পর্যন্ত এই রোগীকে রাখতে যা খরচ তা অনেকের পক্ষেই বহন করা অসম্ভব। এই সময়টা বরং বাড়িতে প্রিয়জনের যত্ন দরকার, আর দরকার ছোটখাটো চিকিৎসা। কিন্তু এখনকার দিনে বাড়ির লোকেদের পক্ষে সেই সময় দেওয়া সম্ভব হয় না, অনেকের লোকবলও নেই। বেশির ভাগ চিকিৎসকও এখন বাড়ি গিয়ে রোগী দেখতে চান না। তাই বাড়ি গিয়ে নিখরচায় এমন রোগীদের দেখভাল ও প্রয়োজনীয় সহযোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন স্বেচ্ছাসেবীরাই।

হয়তো রোগীর যন্ত্রণা বেড়েছে, মুখে ঘা হয়েছে, মলমূত্র ত্যাগে সমস্যা হচ্ছে, খাবার গিলতে পারছেন না, গায়ে র‌্যাশ বেরিয়েছে, খাবার ইচ্ছে চলে গিয়েছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বা পেটে জল জমছে, শরীর হঠাৎ বেশি খারাপ করেছে অথবা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। দরকার মনের কথা বলার একটা লোক। তখন সেই অমূল্য সাহচর্য ও পরিচর্যা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন কিছু মানুষ, কেবল মনুষ্যত্বের স্বার্থে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE