সাবধান: হাওড়া ফেরিঘাটে বিপদ সঙ্কেত লাগাচ্ছেন সিভিক পুলিশকর্মী। শুক্রবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
‘‘কাউন্টার! ও কাউন্টার!’’ গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁক পাড়ছেন লঞ্চের কর্মী উত্তম পুরকাইত। সেই ডাক শুনে বৃষ্টি মাথায় দ্রুত পায়ে লঞ্চের দিকে এগোতে থাকলেন হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির টিকিট কাউন্টারের কর্মী। তাঁকে দেখা মাত্র ওই কর্মী ফের হাঁক পাড়লেন, ‘‘গেটে, ও গেটে!’’ অর্থাৎ বাগবাজার ঘাটের গেটে কর্তব্যরত কর্মীকে এ দিনের মতো ফেরি পরিষেবার শেষ লঞ্চ ধরার জন্য ডাকছেন তিনি। ঘূর্ণিঝড় ফণীর জন্য শুক্রবার দুপুরে আগাম সতর্কতার সেই ডাক বাগবাজার থেকে প্রিন্সেপ ঘাট এবং গঙ্গার পাড় বরাবর সুদূর বিস্তৃত হয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দোকানপাট যাতে বন্ধ রাখা হয়, কেউ যেন গঙ্গায় না নামেন সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলেই পুলিশ-প্রশাসন সতর্ক করেছে। যার প্রেক্ষিতে প্রিন্সেপ ঘাটের সাজানো পথ ধরে প্রিয়জনকে নিয়ে হাঁটা হয়নি সোনারপুরের বাসিন্দা ত্রিদিব সাহার। মিলেনিয়াম পার্ক থেকে একই আক্ষেপ নিয়ে বাড়ি ফেরেন পিকনিক গার্ডেনের বাসিন্দা ফিরদৌস হোসেন। শুক্রবার পারলৌকিক কাজের জন্য শুধু জাজেস ঘাটে সাধারণের প্রবেশের অনুমতি ছিল। বৃষ্টিভেজা বিকেলে প্রিন্সেপ ঘাটের মেজাজ এ দিন বড়ই বেসুরো। ঘাটে পা ছড়িয়ে সেলফি তোলার পরিচিত দৃশ্য নেই। গঙ্গা দিয়ে হাওয়া ছাড়া আর কিছুরই যাতায়াত নজরে পড়ে না। দু’পাশে সবুজের রক্ষী নিয়ে ফাঁকা বেঞ্চগুলিতে যেন অপেক্ষার অবয়ব বসে রয়েছে। যেন প্রশ্ন করছে কত দূরে সে? বাবুঘাটের কোলাহল উধাও। বাস ধরার কোনও তাড়া নেই। কলকাতা থেকে পুরীগামী বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে।
প্রশাসনের নির্দেশে পানিঘাটে এ দিন নৌকাবিহারের সুযোগ ছিল না। ঠিক যেমন শুক্রবার দুপুর একটা থেকে শনিবার পর্যন্ত ফেরি পরিষেবা বন্ধ রাখার নির্দেশিকা জারি করেছে হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতি। নদীকূলে বসে মোবাইলে উপকূল এলাকার পূর্বাভাসের খোঁজে ব্যস্ত থেকেছেন মাঝি হাসিবুল মোল্লা, আন্নান মল্লিকেরা। এ রাজ্যে ৯০-১০০ কিলোমিটার গতিবেগে ফণী ঢুকবে জেনে হাসিবুল বলেন, ‘‘দাদা, জান আগে। তাই প্রশাসন বলা মাত্র নৌকাবিহার বন্ধ রেখেছি।’’
এ দিন এই আশঙ্কার কোলাজে ঘেরা ছিল গঙ্গার পাড়। সেই আবহে নদী তীরবর্তী হাওয়া যখনই জোরালো হয়েছে, আকাশে চোখ রেখে পূর্বাভাস মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন গঙ্গার ধারের বাসিন্দারা। কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে অঙ্গনওয়াড়ির কচিকাঁচারা বৃষ্টি বাদলের দিনে ডিমসেদ্ধ আর আলুভাতের স্বাদে মজে উঠেছিল। কুমোরটুলির চাঁপাতলা ঘাটে স্নান করতে করতে রতন দে জানান, দশ বছর আগের দুপুরে আয়লার সময় গঙ্গায় স্নান করছিলেন বাদল (পদবিটা মনে করতে পারলেন না)। ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়ে কী ভাবে তাঁর বন্ধু গাছের ডাল ধরে বেঁচেছিলেন, সেই গল্প বলেই গঙ্গায় ডুব দিলেন প্রৌঢ়। ঘাট থেকে উঠলে অবশ্য কর্মব্যস্ততার চেনা ছবি। নদী তীরবর্তী বড়বাজারে লরি থেকে মাল খালাস করতে ব্যস্ত তখন মুটে-মজদুরেরা। দুর্যোগের দিনেও এমন কর্মব্যস্ততার কারণ জানতে মোটা পলিথিনে ঢাকা রশির টান যত জোরে সম্ভব কষে বিরাজ শেখ বলেন, ‘‘কী করব! কাজ করে তো খেতে হবে। ঝড় যখন আসবে তখন দেখা যাবে।’’
রুজির ধর্মে পরমেশ্বর দোবাই আর বিরাজ শেখের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সাতান্ন বছরের পরমেশ্বরের বাড়ি ওড়িশার ভদ্রকে। কিছু ক্ষণ আগেই বাড়ির লোকের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ভদ্রক থেকে পুরীর দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের বেশি। আমাদের ওখানে ঝড় তেমন নেই। তবে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড় তো এই প্রথম নয়। মোবাইলের টাওয়ার ধরছে মানে জানবেন সব ঠিক আছে। চার পুরুষ ধরে কলকাতায় আছি। এই গঙ্গার ঘাটই আমাদের সব। এই ঘাট ছেড়ে কোথায় যাব!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy