বারাসতে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ই-কর্নারে টাকা নেই। পেনশন তোলার অপেক্ষায় বৃদ্ধ।
মানুষের ধৈর্যের বাঁধে আর আগল নেই, এ বার সেটা ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা না পেয়ে এ বার ব্যাঙ্ক ভাঙচুর করলেন ক্ষিপ্ত গ্রাহকেরা। সেই সঙ্গে ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হল ব্যাঙ্ক সংলগ্ন এটিএম কিয়স্কটিও। অবস্থা সামাল দিতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়। বুধবার দুপুরে হাওড়ার জগদীশপুরে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় ওই ঘটনা ঘটেছে।
টাকা পেতে এ দিন ভোর থেকেই ব্যাঙ্কের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন গ্রাহকেরা। ক্রমশ সংখ্যাটা হাজার পেরিয়ে যায়। টাকা কিন্তু এক জনও তুলতে পারেননি। বেলা তিনটে নাগাদ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, টাকা নেই। এর পরেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। ব্যাঙ্কের কাচের দরজা, সিসিটিভি, ব্যাঙ্ক লাগোয়া এটিএমে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু হয়। ব্যাঙ্ক সূত্রে বলা হয়েছে, বেলা ১২টা নাগাদ টাকা চলে আসবে বলে ভাবা হয়েছিল, কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত পৌঁছয়নি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন এল না, তখন ওই ঘোষণা করা হয়।
শামিমা বেগম নামে এক গ্রাহকের কথায়, ‘‘চার দিন ধরে ঘুরছি। টাকা পাইনি। এ বার বিষ খেতে হবে।’’
এ দিন খাস নবান্নের এটিএম থেকে আগে কে টাকা তুলবে, তা নিয়ে বচসা এবং শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি বাঁধার উপক্রম হয়েছিল। তখন বেলা পৌনে তিনটে। নবান্নে ইউবিআই-এর এটিএম বুথে তখনই টাকা ঢুকেছে। ৫০০, ১০০ টাকার নোট ঢুকেছে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ছুট, ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি, বাইরে থেকে লাইনে ঢুকে পড়ার চেষ্টা কারও কারও। শেষমেশ পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
হাওড়ার জগদীশপুরে ভাঙচুরের পরে এসবিআই-এর সেই শাখা।
এতদিন নবান্নের ওই এটিএম বুথে ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবেই টাকা তুলেছেন সরকারি কর্মীরা। কিন্তু এ দিনের ঘটনায় প্রমাণিত, তাঁরা ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছেন।
ধৈর্য যে আর বাঁধ মানছে না, সেটা এ দিন বোঝা গিয়েছে ব্যাঙ্কে টাকা তোলার জন্য কার্যত হত্যে দিয়ে থাকা লোকজনের প্রতিক্রিয়া থেকে। এই ক’দিন যাঁরা বলছিলেন, দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য একটু অসুবিধে মেনে নিতে হবে, এ দিন তাঁদের একাংশের মুখে অন্য সুর।
শ্যামবাজারের দেশবন্ধু পার্ক এলাকার বাসিন্দা বিশ্বনাথ সান্যাল এত দিন নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে জরুরি বলে বাকিদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কেবল কয়েকটা দিন একটু ঝামেলা পোহাতে হবে। আর বুধবার দুপুরে শ্যামবাজারের রাষ্ট্রায়ত্ত শাখার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বছর পঞ্চান্নর সেই বিশ্বনাথবাবু বললেন, ‘‘আর তো পারা যাচ্ছে না। এতটা ভোগান্তি মানুষের প্রাপ্য ছিল না।’’
আসলে নোট বাতিলের ঘোষণার পর ২২ দিন, মানে তিন সপ্তাহেরও বেশি পেরিয়েছে। অনেকেরই এখন অভিমত: দেশের মঙ্গলের ভাবনা আপাতত তাকে তোলা থাক। মাসপয়লার দরজায় দাঁড়ানো দিশেহারা মধ্যবিত্ত এ বার চাইছেন, নোটের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি।
উত্তর কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তার কথায়, ‘‘এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এত দিন আমাদের ভরসা ছিল, গ্রাহকদের সহযোগিতা। কিন্তু এ বার সেটাও আমরা হারাতে বসেছি।’’
অধিকাংশ এটিএম-ই ‘নো ক্যাশ’-এর নোটিসে মুখ ঢেকেছে। আর তাতে ব্যাঙ্কগুলির চাপ বেড়েছে। বাগবাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পেনশন তুলতে আসা পঁয়ষট্টি বছরের অবিনাশ ঘটক বলেন, ‘‘আমার আর গিন্নির ডাক্তার-ওষুধ বাবদ মাসে হাজার কুড়ি টাকা খরচ হয়। প্রথমটায় মনে হয়েছিল দেশের ভালই হবে। এখন মনে হচ্ছে, পরিকল্পনাটার গোড়ায় গলদ।’’ শোভাবাজারের বেসরকারি কর্মী সোহিনী পালের কথায়, ‘‘কাল থেকে রাঁধুনি, পরিচারিকা, ড্রাইভার— সবাইকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু টাকা তো তুলতেই পারছি না!’’ ওই মহিলা ২৪ হাজার টাকা তুলতে গিয়ে, তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তুলতে পেরেছেন কেবল দশ হাজার।
বেহালার লক্ষ্মীকান্ত মাইতি রাসবিহারী মোড়ের একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের সামনে এ দিন দু’ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা পেলেন না। আজ এই নিয়ে টানা পাঁচ বার খালি হাতে ফিরতে হল তাঁকে।
পেশায় বিমাকর্মী, মধ্যমগ্রামের প্রদীপকুমার বসু এ দিন বেতন পাওয়ার পরে ২০ হাজার টাকা তুলতে যান। কিন্তু সকাল থেকে তিন ঘণ্টা লাইন দিয়েও টাকা পাননি। তাঁর কথায়, ‘‘সিদ্ধান্ত যতই ভাল হোক, পরিকল্পনা না থাকলে সবটাই শূন্য।’’
দমদমের সুযশ দত্ত মুদিয়ালির একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী। তিনিও বেতনের টাকা তুলতে এ দিন সকালে রাসবিহারীর একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে দু’ঘণ্টা ধরে লাইন দেন। তার পর ব্যাঙ্কের তরফে বলা হয়, টাকা নেই।
যেখানে যতটুকু টাকা পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই দু’হাজারি নোটে। পাঁচশো টাকার নোট অধিকাংশ ব্যাঙ্কেই নেই বললেই চলে। আর একশো বা পঞ্চাশের ছোট নোট মিললেও তা বেশির ভাগই ছেঁড়া। মুর্শিদাবাদের শ্রমিক মহম্মদ শাহিদই যেমন বালিগঞ্জের একটি ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার পেয়েছেন, যার সবই ছেঁড়া ৫০ টাকার নোট। বেশ কয়েকটিতে সেলোটেপও লাগানো। ‘‘লাইন দিয়ে টাকা তুললাম, এ বার এগুলি বদলাতে আবার লাইন দিতে হবে’’— বিরক্তি তাঁর। ডেকার্স লেনের এক ব্যবসায়ী আবার দশ টাকার কয়েনে পেয়েছেন চার হাজার টাকা।
আবার এসবিআইয়ের কেষ্টপুর শাখায় সকালে দু’ঘণ্টা ‘লিঙ্ক ফেলিওর’ ছিল এ দিন। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থও হয়ে পড়েন এক প্রবীণ। দুপুরে লিঙ্ক ঠিক হওয়ার পরে নির্বিঘ্নে টাকা জমা ও তোলা গিয়েছে বলে গ্রাহকেরা জানান। অবশ্য মাথাপিছু ছ’হাজার টাকা।
বুধবার ছবি দু’টি তুলেছেন সুদীপ ঘোষ ও দীপঙ্কর মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy