পুড়ে গেছে পড়ার বই।
রেললাইনের ধার ঘেঁষে ঢালাও ঘিঞ্জি জনবসতির ছবি মহানগরের চেনা। ছোট ছোট ঝুপড়িতে বেড়ে চলে মানুষ। আর তাঁদের উপরে যখনই নেমে আসে বিপদের আঁচ, তখনই শুরু হয় পরস্পরকে দোষারোপের পালা। এই ধারা দেখেছে উল্টোডাঙা রেলবস্তি, বাঘা যতীন রেলবস্তি। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে, একাধিক প্রাণের বিনিময়ে তারা দাম চুকিয়েছে ‘জবরদখলের’। এ বার একই ছবি দেখল পাতিপুকুরের রেললাইন ঘেঁষা সুভাষ কলোনি।
তথ্য বলছে, এই জমি রেলের। যেখানে প্রায় চার দশক জবরদখল করে বাস করছেন হাজারখানেক মানুষ। এত দিন ধরে রেলের জমি কী ভাবে দখল করে রেখেছেন এঁরা? কখনও কি তাঁদের সরানোর চেষ্টা হয়নি? রেলের স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। সারা দেশের দখল হওয়া জমি নিয়েই একটি দার্শনিক উত্তর এসেছে। বলা হয়েছে, সারা দেশে রেলের যত জমি আছে, তার বেশির ভাগটাই জবরদখল হয়ে আছে। সেগুলি ফাঁকা করার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার ও প্রশাসনকে একাধিক বার চিঠি পাঠিয়েছে রেল। চিঠি ফাইলবন্দিই থেকেছে। নির্দিষ্ট করে এই পাতিপুকুর বস্তি উচ্ছেদের জন্য কোনও বিশেষ পদক্ষেপ হয়েছে কি না, তার উত্তর মেলেনি।
বরং রেলের তরফে অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক চাপান-উতোরের। এক রেলকর্তার কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির জন্য এই জমি-সমস্যা তুঙ্গে। ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সমস্ত রাজনৈতিক দলই। রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের সহায়তা না পেলে উচ্ছেদ সম্ভব নয়।’’ তাঁর অভিযোগ, প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বহু ক্ষেত্রে। শিয়ালদহ মেন লাইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘যাত্রী-সংখ্যার এত চাপ সত্ত্বেও বারো কামরার লোকাল ট্রেন চালানো যাচ্ছে না প্ল্যাটফর্মের অভাবে। প্ল্যাটফর্ম বাড়াতে যে জমি প্রয়োজন, তা তো দখল হয়ে রয়েছে।’’
হাহাকার। আগুনের গ্রাসে গিয়েছে ঘরবাড়ি।
পাতিপুকুরের রেলবস্তিও তাই। উচ্ছেদের কোনও পদক্ষেপ তো হয়ইনি, বরং ক্রমে সেখানে পৌঁছেছে জল, বিদ্যুৎ, নিকাশির মতো পরিষেবা। প্রজন্ম পেরিয়েছে, শক্ত হয়েছে বসবাসকারী মানুষগুলির শিকড়। ভোটের দিকে তাকিয়ে বছরের পর বছর তাঁদের আগলে রেখেছে শাসক দল। প্রসঙ্গত, ঢাকুরিয়া সংলগ্ন এলাকায় গোবিন্দপুর রেলবস্তি উচ্ছেদ অভিযানের কথা মনে করালেন এক রেলকর্তা। বেশ কয়েক বছর আগে ওই বস্তি উচ্ছেদ করতে গিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে পড়েছিল রেল। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মানুষ শখ করে রেললাইনের ধারে থাকে না, বাধ্য হয়েই থাকে। আর সে সব মানুষের জন্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের দায়বদ্ধতা থেকেই যায়।’’
তাঁর যুক্তি, রেল বলছে ‘সরকার ওদের সহায়তা দেয় কেন’। রাজ্যও তো বলতে পারে, রেল তাদের জায়গা ঘিরে রাখতে পারত, বসার সময়ে রুখতে পারত। তিনি জানান, প্রশাসনের দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁদের পরিষেবা দেওয়া হয়েছে।
যুক্তি আছে জবরদখলকারীদেরও। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, দু’-তিন প্রজন্ম ধরে এখানে আছেন তাঁরা। পুনর্বাসন না পেলে উঠে যাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও তেমনই। বস্তি উচ্ছেদের প্রাথমিক শর্ত হল পুনর্বাসন। এতগুলি বছর ধরে সেই উদ্যোগ না নিয়েছে সরকার, না রেল। দু’পক্ষই চিঠি চালাচালি এবং পরস্পরকে দোষারোপ করে থেমে রয়েছে এত বছর।
এলাকার এক তৃণমূল নেতা সন্দীপ রায়চৌধুরীর স্পষ্ট অভিযোগ, ‘‘ভোটের জন্য এত জন জবরদখলকারীকে পুষেছে বামফ্রন্ট। অথচ সুরক্ষার দিকে নজর রাখেনি।’’ কিন্তু সরকারের পালা তো বদলেছে। কলোনির হাল বদলাল না কেন? কেনই বা রেলজমি দখলমুক্ত করার কোনও পদক্ষেপ হল না?
স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তনু সেন বলেন, ‘‘এত মানুষ যাবেন কোথায়? এঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রেলের সঙ্গে যে কোনও রকম আলোচনা করতে প্রস্তুত আমরা। রেল অসহযোগিতা করেছে। আমি মনে করি আগে মানবিকতা, পরে আইন।’’ তাঁর অভিযোগ, বস্তিবাসীদের জন্য আলো, জল, পরিচ্ছন্নতা— সব উদ্যোগেই বাধা দিয়েছে রেল। এ দিন এত বড় দুর্ঘটনার পরেও কোনও রেলকর্তার দেখা মেলেনি। ঘটনার পরে রেলের কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল, ওই এলাকাটুকু পেরোনোর সময়ে ট্রেনগুলির গতি একটু কম রাখতে। তাতেও রাজি হয়নি। মানুষগুলি বিপজ্জনক ভাবে রেললাইনের পাশে বসে আছেন। ক্ষুব্ধ শান্তনুবাবুর মন্তব্য, ‘‘হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য বলেই এই মানুষগুলির প্রতি এত অসহযোগী রেল।’’
শনিবার সকালে পাতিপুকুরের বস্তিতে ছবি দু’টি তুলেছেন স্বাতী চক্রবর্তী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy