Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

শুধু পরোটার স্টল থেকেই ‘আদায়’ দিনে ৩০০ টাকা

সিন্ডিকেট, তোলাবাজি নিয়ে একাধিক বার দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তোলাবাজির অভিযোগে বিধাননগর পুরসভার এক তৃণমূল কাউন্সিলর এখনও জেলে।

সেই স্টল। — নিজস্ব চিত্র

সেই স্টল। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০৭:৩৩
Share: Save:

সিন্ডিকেট, তোলাবাজি নিয়ে একাধিক বার দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তোলাবাজির অভিযোগে বিধাননগর পুরসভার এক তৃণমূল কাউন্সিলর এখনও জেলে। দিন কয়েক আগেও দলীয় পুর-কাউন্সিলরদের নিয়ে নজরুল মঞ্চে এক কর্মশালায় নেত্রীর স্পষ্ট বার্তা ছিল, নোট তোলায় নজর দিলে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু বাস্তব ছবিটা বদলায়নি।

উত্তর কলকাতার এক কাউন্সিলরের সঙ্গে দমদম রোডে ফুটপাথের এক পরোটা বিক্রেতার ফোনের কথোপকথনে তা ফের স্পষ্ট।

৭ নম্বর দমদম রোডের পাশে ফুটপাথে পরোটা বিক্রি করেন এক ব্যক্তি। টেলিফোনে কথোপকথনের ভিত্তিতে অভিযোগ, ওই দোকানের মালিক লক্ষ্মণের (পরোটা লক্ষ্মণ বলে পরিচিত) কাছ থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে ‘তোলা’ নেন কলকাতা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর। সেই কথোপকথনে শোনা গিয়েছে, লক্ষ্মণ কাউন্সিলরকে বলছেন, জুন মাসের জন্য ৭৮০০ টাকা তিনি কাউন্সিলরের লোকের হাতে দিয়েছেন। এবং হিসেব দিতে গিয়ে এমন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন যে, মাসের চারটি রবিবার দোকান বন্ধ থাকে বলে তিনশো টাকা হিসেবে ২৬ দিনের জন্য ৭৮০০ টাকা। সেই কথোপকথন থেকে আরও জানা গিয়েছে, কাউন্সিলরের লোকের হাতে টাকাটা আগে দেওয়া হলেও তা পৌঁছতে দেরি হওয়ায় ধমক খাচ্ছেন সেই দূত। যাঁকে নিজের সেক্রেটারি বলেই উল্লেখ করছেন কাউন্সিলর।

সেই কথোপকথনের ‘অডিও’র প্রসঙ্গ শুনেই প্রথমে তা অস্বীকার করেন কলকাতা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুষ্পালি সিংহ। যদিও অডিওটি শুনেই অনেকের দাবি, এটি পুষ্পালিদেবীরই গলা। পরে অবশ্য পুষ্পালিদেবী বলেন, ‘‘এ সব আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত। দলেরই স্থানীয় কিছু নেতা আমাকে হেনস্থা করতে এ সব জঘন্য কাজ করে চলেছেন। যে দিন থেকে আমি এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়েছি, তখন থেকেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।’’

কলকাতা পুরসভার একাধিক মেয়র পারিষদ এবং কাউন্সিলরও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। অডিও কথোপকথন শুনে তাঁদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘এ তো পুষ্পালি সিংহের গলা।’ এমনকী, তাঁরাও ওই অডিও ক্লিপ শুনেছেন বলে জানান। পরোটা বিক্রেতা লক্ষ্মণের কাছ থেকে তোলা আদায়ের অভিযোগ ছাড়াও ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন দমদমেরই এক বাসিন্দা কৃষ্ণপদ ঘোষ। অভিযোগ, বাড়ি তৈরি করতে যাওয়ায় তাঁকে দু’লক্ষ টাকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন কাউন্সিলরের প্রতিনিধি। কৃষ্ণবাবু নিজেই সে কথা জানিয়ে শনিবার বলেন, ‘‘কাউন্সিলরের তরফে দু’জন এসে আমাকে বললেন, দু’লক্ষ টাকা দিতে হবে। বললাম, অত দিতে পারব না। পরে দরাদরি করে এক লক্ষ দিতে হল। কিন্তু তার পরেও কাজ না হওয়ায় টাকা ফেরত চাই। মাত্র ২০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। বাকি টাকার জন্য বারংবার বলেও কোনও ফল হয়নি। এক দিন সংবাদপত্রে তোলাবজির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য দেখে নবান্নে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিই।’’ তাতেই কাজ হয় বলে জানান কৃষ্ণবাবু। বললেন, ‘‘এক দিন মেয়রের কাছে গিয়ে জানলাম চিঠিতে কাজ হয়েছে। মেয়রের কাছে এসেছে পুরো বিষয়টি।’’ মেয়র শোভনবাবুই কাউন্সিলরকে ডেকে বাকি ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ সব কিছুই হয়েছে মেয়রের চেম্বারে।

এ বার পরোটা বিক্রেতা লক্ষ্মণের সঙ্গে কথোপকথনের ‘অডিও ক্লিপ’ আরও এক দফা অস্বস্তিতে ফেলল পুষ্পালিদেবীকে। ওই কথোপকথনের বয়ান অনুসারে লক্ষ্মণবাবুর কাছে স্থানীয় কেউ রক্তদান শিবিরের জন্য ২০ হাজার টাকা চেয়েছেন। তা দিতে নারাজ লক্ষ্মণবাবু। পুষ্পালিদেবীর পাঠানো লোকজনের কাছে সেটাই বলছেন তিনি। সেই লোকই নিজের ফোন থেকে লক্ষ্মণের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছেন পুষ্পালিদেবীর।

এখন প্রশ্ন, ফুটপাথের এক পরোটাওয়ালা কত টাকা আয় করেন? দৈনিক ৩০০ টাকা দিচ্ছেন। আবার কেউ রক্তদান শিবিরের জন্য ২০ হাজার দিতে বলছেন।

টুঁ শব্দটি করতে নারাজ লক্ষ্মণবাবু। ওই ফোনের কথা জানাজানি হতে তিনিও ভয়ে রয়েছেন। দোকান যদি বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে পরিবার নিয়ে পথে বসবেন। সকাল-সন্ধ্যে দু’বেলা দোকান খোলেন। পরোটার সঙ্গে আলুর দম। প্রতি পিস তিন টাকা। দমদম স্টেশনের কাছে পরোটা বিক্রেতা লক্ষ্মণকে এক ডাকে সবাই চেনে। দোকান ফুটপাথে হলেও বেচাকেনা ভালই হয়। লাইন দিয়ে লোকে পরোটা কেনেন। আবার অনেক পার্সেলও হয়। পাশেই এক দোকানির কথায়, ‘‘দিনে হয়তো কয়েক হাজার টাকারও বেশি বিক্রি হয়। লাভও ৫০ ভাগ।’’ তিনশো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বলেই ওই ফুটপাথের দোকানের উপরেও নজর স্থানীয় নেতাদের, জানালেন এলাকারই একাধিক ব্যবসায়ী।

দলেরই এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ ওঠা নিয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘এ ধরনের নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নিই। কারও ক্ষেত্রেই এটা সহনীয় বিষয় নয়। বাঞ্ছনীয়ও নয়। অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

extorsion puspali sinha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE