এ রকমই অবস্থা নিমতলার এক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের। —নিজস্ব চিত্র
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের হাল কতটা শোচনীয় হতে পারে তা নিয়ে গ্রামীণ এলাকার সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে শহর কলকাতা!
মাত্র পাঁচ-ছয় দিন আগেই রাজ্যের ৬টি জেলার গ্রামীণ এলাকার ২২টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের উপর সমীক্ষা চালিয়ে তৈরি রিপোর্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করেছিল অমর্ত্য সেন স্থাপিত প্রতীচী ট্রাস্ট। তাতে দেখা গিয়েছিল, শৌচালয় ও পানীয় জলের সঙ্গীন দশা অধিকাংশ কেন্দ্রে। ৭১.৫% কেন্দ্রে কোনও শৌচালয় নেই। পানীয় জল নেই ৫০% কেন্দ্রে। কিন্তু রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরই স্বীকার করছে, শুধুমাত্র গ্রামীণ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেরই নয়, বরং রাজ্যের রাজধানী শহর কলকাতায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির অবস্থা আরও বেশি খারাপ।
কলকাতায় আপাতত ১৫২৬টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলছে। তার মধ্যে সাকুল্যে মাত্র ৪৭৯টি কেন্দ্রে শৌচালয় রয়েছে। অর্থাৎ ১০৪৭টি কেন্দ্র চলছে বিনা শৌচালয়ে। ওই কেন্দ্রগুলির দায়িত্বে থাকা প্রজেক্ট অফিসারেরা জানিয়েছেন, সেখানে ৩-৬ বছরের শিশু এবং শিশুকে দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের পাঁচ-ছ’ঘণ্টা মল-মূত্রের বেগ চেপে থাকতে বাধ্য হতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা চাপতে না পেরে কেন্দ্রের ভিতরে বা আশপাশে খোলা-অপরিষ্কার জায়গায় শৌচকর্ম করছে। এতে তারা নিজেরা যেমন ডায়রিয়া-সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনই নোংরা হচ্ছে পরিবেশও। আর শৌচাগার নেই বলে মায়েরা সেই সব কেন্দ্রে আসতেই চাইছেন না। ফলে এঁদের অনেকেই পুষ্টিকর খাবার এবং রুটিন চেকআপ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রজেক্ট অফিসারদের কথায়, যে সব জায়গায় শৌচালয় রয়েছে, সেখানেও অধিকাংশেরই অবস্থা ভয়াবহ। সেগুলি ব্যবহার করাই দায়। শুধু তা-ই নয়, সমাজকল্যাণ দফতরের রিপোর্টেই প্রকাশ, কলকাতার মাত্র ৭৩২টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পানীয় জলের লাইন ও কল রয়েছে। বাকি কেন্দ্রগুলিতে শিশুরা কী জল খাচ্ছে, তাদের রান্না হচ্ছে কোন জলে, তার উপর কোনও নজরদারি নেই। আলাদা রান্নাঘর নেই বেশির ভাগেরই। অনেক জায়গায় পরিচ্ছন্নতার তোয়াক্কা না করে রান্না হয় বাইরে খোলা আকাশের নীচেই।
কলকাতা শহরের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি মূলত ১২টি প্রজেক্ট-এলাকায় বিভক্ত। সমাজকল্যাণ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে খিদিরপুর এলাকার ১৭৬টি কেন্দ্রের একটিতেও শৌচালয় নেই। এন্টালি এলাকার ১৯৬টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৫৪টিতে, গার্ডেনরিচের ১৩০টির মধ্যে ৩৪টি কেন্দ্রে, বেলেঘাটার ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে, শহরের যৌনপল্লিগুলির ১০২টির মধ্যে ২৭টি কেন্দ্রে শৌচালয় রয়েছে। আবার বাগবাজার বা টালিগঞ্জের মতো এলাকার কেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো ও কাজকর্ম নিয়ে কোনও রিপোর্টই মাসের পর মাস সমাজকল্যাণ দফতরে জমা পড়েনি। ফলে সেখানে কী অবস্থা চলছে সে সম্পর্কে অন্ধকারে দফতরের কর্তারা।
জোড়াবাগানে পুরনো থানার উল্টো দিকের গলিতে এ রকম একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে যেমন দেখা গেল, বড়জোড় সাত ফুট বাই ন’ফুটের একটি জানালাবিহীন খুপরি ঘর। তাতে ডাঁই করা জিনিসপত্র। নড়াচড়া করাই দায়। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে ১৯ জন শিশু চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকে। কোনও শৌচালয় নেই, রান্না হয় বাইরে ফুটপাথে। একই অবস্থা নিমতলায় গঙ্গার পাশে একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের। সেখানে ঘরটি তুলনায় বড় হলেও চাল খসে পড়ছে। ঘরময় ইঁট-কাঠ, হাঁড়ি-কুড়ি, সিমেন্টের চাঙড় আর আবর্জনায় ভর্তি। সেখানেও শৌচালয় নেই। প্রজেক্ট অফিসারেরা স্বীকার করেন, কলকাতার বেশিরভাগ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেরই কমবেশি এই অবস্থা।
সমাজকল্যাণ অধিকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেন, গ্রামের তুলনায় কলকাতায় জায়গার অভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। কলকাতার প্রায় সব অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ক্লাবঘর ভাড়া নিয়ে চলছে। সেখানে পরিকাঠামো সংশোধনের সুযোগ থাকছে না। ফলে কাছাকাছি স্কুলগুলিতে কেন্দ্রগুলি স্থানান্তরিত করা যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে দফতর। সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেনের কথায়, “ক্লাবগুলির বেশিরভাগের জমিজমার বৈধ কাগজ পাওয়া যায় না। ফলে দরকারেও জমিতে শৌচালয় বানানো যাচ্ছে না। শহরের মধ্যে অন্যত্র সরকারের বাজেটের মধ্যে নতুন জায়গা খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।” অতএব, কলকাতায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শৌচালয় ও পানীয় জলের সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিতে পারছেন না সমাজকল্যাণ কর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy