Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

জোছনা আড়ি করলেও ভাব তাঁর সঙ্গীতের সঙ্গে

লখনউয়ের ‘পসন্দাবাগ’-এর সেই সমাধিটার উপর জমেছিল শুকনো ঝরা পাতা। জ্বলছিল কয়েকটা মোমবাতি। এক গোছা গোলাপ রাখতে গিয়ে মাটিতে আলগোছে ছড়িয়ে পড়ল কয়েকটা পাতা। নিমেষেই ভেঙে গেল অনন্ত নীরবতা। যার এক প্রান্তে ‘রুহি-গুলাবের’ গন্ধমাখা ঠুমরি, দাদরা কিংবা গজলের স্মৃতিসুধা। অন্য প্রান্তে, জমে থাকা বিরহ, বিষণ্ণতা আর যন্ত্রণা। আর এ দুয়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার কাহিনি।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

লখনউয়ের ‘পসন্দাবাগ’-এর সেই সমাধিটার উপর জমেছিল শুকনো ঝরা পাতা। জ্বলছিল কয়েকটা মোমবাতি। এক গোছা গোলাপ রাখতে গিয়ে মাটিতে আলগোছে ছড়িয়ে পড়ল কয়েকটা পাতা। নিমেষেই ভেঙে গেল অনন্ত নীরবতা। যার এক প্রান্তে ‘রুহি-গুলাবের’ গন্ধমাখা ঠুমরি, দাদরা কিংবা গজলের স্মৃতিসুধা। অন্য প্রান্তে, জমে থাকা বিরহ, বিষণ্ণতা আর যন্ত্রণা। আর এ দুয়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার কাহিনি।

উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ১৯১৪ সালে জন্ম আখতারির। তাঁর বাবা ছিলেন অভিজাত সৈয়দ পরিবারের মানুষ। তো সেই ভদ্রলোকের তৃতীয় স্ত্রী মুস্তারি বেগমের যমজ দুই মেয়ে ছিল। জোহরা এবং বিবি। পরবর্তী কালে সম্পত্তিজনিত কারণে মুস্তারির স্বামী তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। ইতিমধ্যে মারা যায় জোহরা। জীবন সংগ্রামে একা মুস্তারি নানা বাধা-বিপর্যয় পেরিয়ে তাঁর আদরের বিবিকে বড় করে তুলছিলেন। এই বিবি-ই পরবর্তী কালে হয়ে উঠবেন ‘মালিকা-এ-গজল’ বেগম আখতার।

একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয় বিবিকে। সেই স্কুলে এক দিন অর্থ সাহায্য করতে এলেন গহরজান। শোনা যায়, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষিকা যখন গহরজানকে স্কুল ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে অবাক হয়ে দেখছে তাঁর বহুমূল্য ওড়নাটি। গহর সস্নেহে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম?’ উত্তর দেওয়ার সময় তার কণ্ঠস্বরই গহরজানকে বুঝিয়ে দেয় যে, সে গান গায়। তাঁর কথাতেই বিবি গেয়ে উঠেছিল, একটি কলি। অথচ এর আগে বিবি কোনও দিন গান গায়নি। সেই এক কলি গান শুনেই গহর নিশ্চিত হয়েছিলেন, এই মেয়ে এক দিন বড় শিল্পী হবে।

ইতিমধ্যে মুস্তারি মেয়ে বিবিকে নিয়ে গয়াতে তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেন। বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ-র কাছে সেখানে বিবি তালিম নেওয়া শুরু করে। এমনই এক সময় পটনায় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যার্থে একটি বড় সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে মুস্তারি অনেক কাকুতিমিনতি করে বিবির গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানে বছর দশেকের বিবির গান শুনে একটি রেকর্ড কোম্পানি তার গান রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। রেকর্ড হল। কিন্তু, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি-র সেই রেকর্ড বাজারে তা চলল না।

হতাশ মুস্তারি এর পর মেয়েকে নিয়ে গেলেন এক পীরের কাছে। সব দেখেশুনে সেই পীর নাকি বলেছিলেন, ‘এক দিন এই মেয়ের সামনে সারা পৃথিবী মাথা নত করবে।’ তিনি বিবিকে গানের খাতাটা খুলতে বলেন। তার পর চোখ বন্ধ করে হাত রাখেন খাতার একটি পাতায়। সে পাতাতেই ছিল ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’ গানটি। আশ্চর্যের কথা, সেই গান যখন রেকর্ড হয়ে বেরোল, বিবিকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তেরো বছর বয়সে সেই গান তাকে এনে দিয়েছিল ভারত জোড়া খ্যাতি।

এর পর বিবি অর্থাৎ আখতারি এলেন কলকাতায়। পাতিয়ালার উস্তাদ আতা মহম্মদ খানের কাছে শুরু হল তালিম। প্রথম দিকে আখতারির গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ। জিতেনবাবুর জহুরির চোখ আখতারিকে চিনতে ভুল করেনি।

এরই মধ্যে চোদ্দ বছর বয়সে আখতারি যোগ দিলেন থিয়েটারে। সেখানেও নিজের অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেন। এর পরেই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বম্বে থেকে ডাক আসে। পাশাপাশি আসতে থাকে বিভিন্ন রাজপরিবারে সঙ্গীতের মেহফিলে গান গাইবার অনুরোধ। ‘নলদময়ন্তী’ ছবিতে অভিনয়ের পরে ‘রোটি’তে তিনি অভিনয় করেন। ছবিতে অভিনয়ের আমন্ত্রণের সংখ্যা এর পর যায় বেড়ে। কিন্তু বম্বের জীবনযাত্রা আখতারির না-পসন্দ। তাই তিনি ফিরে এলেন লখনউতে। সেখানেই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বসত গানের মেহফিল।

হঠাৎই এক দিন ডাক পড়ল উত্তরপ্রদেশেরই রামপুরের নবাব-দরবারে। নিমন্ত্রণ রাখলেন আখতারি। কিছু দিন সেখানে থাকার পর, নবাব আখতারিকে নিকাহ্ করার প্রস্তাব দেন। তবে, আখতারি শুধু তা নাকোচই করেননি, রামপুর ছেড়ে চলে গেলেন।

নানা ঘটনার ভেতর দিয়েই কেটে যাচ্ছিল আখতারির জীবন। আচমকাই তাঁর সঙ্গে দেখা হল পেশায় ব্যারিস্টার কাবুলির নবাব ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসির। ঘটনাচক্রে পরে তাঁর সঙ্গেই বিবাহ হয় আখতারির। বিয়ের পর তিনি পেলেন শিক্ষিত-সুপুরুষ স্বামীর ভালবাসা, অর্থ, প্রতিপত্তি, হিরে-জহরত সব কিছুই। শুধু জীবন থেকে বিদায় নিল গান! কেননা, বিবাহে আব্বাসি সাহেবের শর্তই ছিল, আখতারিকে গান ছাড়তে হবে।

কাজেই জীবনের মানেটা বদলে গেল আখতারির কাছে। সব আছে, অথচ কিছুই নেই! সংসার জীবনে একাধিক বার গর্ভবতী হয়েও জন্ম দিয়েছেন মৃত সন্তান। জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই হারিয়ে ফেললেন আখতারি। চিকিৎসক এলেন। পরামর্শ দিলেন, এমন কিছু করার প্রয়োজন হল যাতে আখতারি ভাল থাকেন।

‘শূন্য জীবনে’ নতুন করে শুরু হল গান। গান গাওয়ার পাশাপাশি আখতারি এ বার গান শেখাতেও শুরু করেন। আকাশবাণীর লখনউ-র স্টেশন ডিরেক্টর সুনীল বসু ইতিমধ্যেই আব্বাসি সাহেবের বাড়ি গিয়ে অনেক কাকুতিমিনতি করে বেগমের গান রেকর্ড করতে তাঁকে রাজি করান। আখতারি গান গাইবেন শুনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিল। তবে আর আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি নয়! জন্ম হল এক নতুন শিল্পীর— বেগম আখতার। সেই নামেই প্রকাশিত হল দু’টি বিখ্যাত গান। ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’।

শুরু হল বেগমের নতুন জীবন। যেখানে শুধু গান আর গান। একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছিল রেকর্ড। পাশাপাশি দেশ জোড়া খ্যাতি আর অসংখ্য অনুষ্ঠান। আখতারি যেন নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পেলেন। গজল গায়কির আজকের ধারার প্রবর্তন করেন তিনি।

বাঙালির সঙ্গে আখতারির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বহু দিনের—

ফ্ল্যাশব্যাকে জমিদার বিশ্বম্বর রায়ের ছেলের উপনয়নের সেই সন্ধে। জলসাঘরে গানের আসরে দুর্গাবাঈ ধরলের পিলু ঠুমরি। ‘ভরি ভরি আয়ি মোরি আঁখিয়া’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে আশ্রয় করে সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর সেই গানের মায়াবি মাদকতায় আজও আচ্ছন্ন সঙ্গীত রসিকেরা। সেই সঙ্গেই চিরস্মরণীয় দুর্গাবােঈর চরিত্রে বেগম আখতার।

তাঁকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর সেই সব ঘটনা তো আজ ইতিহাস। কিংবা ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়ির সেই আড্ডা, বা রাত একটার সময় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গান শুনতে যাওয়ার সেই ঘটনার কথা আজ কেই বা মনে রেখেছে! তবুও বাঙালির হৃদয়ে ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘পিয়া ভোলো অভিমান’, ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ ইত্যাদি গান আজও নবীন। ‘আই মোহাব্বত’,‘উয়ো যো হাম মে তুম মে’ কিংবা মির্জা গালিবের লেখা ‘ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ’ বাঙালির কাছে কখনও পুরনো হবে না।

গানের ভেতর জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতেন আখতারি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে আমদাবাদে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাত্র ৬০ বছর বয়সে, সে বছরেরই ৩০ অক্টোবর প্রয়াত হন।

পসন্দাবাগের সেই সমাধির উপর জ্বলতে থাকা বাতিগুলি ধীরে ধীরে যেন নিভে আসছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE