অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।
যদি কুমড়োপটাশ নাচে? মাছ বৃষ্টি হবে কাছে? যদি কুমড়োপটাশ হাসে? মাছ বৃষ্টি দু’হাত ভরে ছড়াই আশেপাশে।
আর যদি কুমড়োপটাশ থাকে? শ্রাবণমাসের রবিপুজোয় আমরা পাব তাঁকে?
সেই একটুকরো মেঘ থেকে কবে যেন দু-তিনটে বৃষ্টির দানা ঝরেছিল আমার উঠোনে। মনে পড়ে আবছা। মাটির কেমন সে সোঁদা গন্ধ উঠেছিল, নেচেছিলাম প্রাণ ভরে। মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো...হালকা হাওয়া দিয়েছিল, ঠিক কবে যেন মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে গুমরেছিল আকাশটা। মনে মনে ডেকেছিল যেন আমাকে, শুধুই আমাকে। খেরোর খাতায় আঁচড় কাটতে কাটতে ভাবছিলাম রবিঠাকুরের কথা। প্রখর গরমে তো তিনিও লিখে ফেলেছিলেন, দারুণ অগ্নিবাণে রে অথবা আমি বৃষ্টিবিহীন, বৈশাখী দিন...কিন্তু আমরা কেন পারি না? যদি এমন হত, বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে রবিঠাকুরের দেখা পেতাম! যদি এমন হত? রবীন্দ্র জলসাতে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে গাইছি সম্মিলিত ভাবে আর লাঠি নিয়ে ঠুক ঠুক শব্দ করে মঞ্চের পেছনে এসে দাড়িবুড়ো দাঁড়িয়েছেন। বাইরে বেরিয়ে দেখি অ-কালবৈশাখীর বৃষ্টির দাপটে আচমকা বানভাসি পথঘাট। কিছুটা অলৌকিক ভাবেই যেন বৃষ্টির আশীর্বাদ রবিকথায় সম্পৃক্ত হয়ে ঝরে পড়বে সে দিন।
আরও পড়ুন: ‘রবিকা’ চলে গিয়েছিলেন অবনের জন্মদিনেই
অলঙ্করণ: অর্ঘ্য মান্না।
সত্যি বোশেখ আর শ্রাবণ এই দু’মাসের সঙ্গে রবীন্দ্র অনুষঙ্গটি বাঙালির জীবনে এতটাই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে শয়নে স্বপনে জাগরণে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ মনন কখনও কখনও ভুলিয়ে দেয় যে তিনি সত্যিসত্যি নেই আমাদের মধ্যে। বৈদ্যুতিন, ডিজিটাল, প্রিন্ট— সকল মাধ্যমেই রবিপুজোর বরণ দেখে সকালে ফেসবুক খুলেই ভাবলাম, আচ্ছা, যদি এমন হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ফেসবুক প্রোফাইল থাকে আর ইথার তরঙ্গে যেমন ভেসে আসে মৃত মানুষের রেকর্ডেড কণ্ঠস্বর, তেমন ভাবেই যদি তিনি সাড়া দেন ফেসবুক চ্যাটে? সবই তো যন্ত্রজালের মায়া। প্রযুক্তিগত কৌশল। রবির আত্মাটুকু যদি এখনও থাকে সে নিশ্চয়ই ফেসবুক চ্যাটে আমায় সাড়া দেবেই। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখি আমার সবুজ বাতিঘরের একটুকরো অলিন্দে মেসেজ এল।
আরও পড়ুন: স্মরণের ফ্রেমে ২২শে শ্রাবণ
মেসেজ এল খটখট করে। আবার বাংলায় টাইপ করা অক্ষরে, ‘আমি তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ আমি কী লিখব তার উত্তরে ভেবে না পেয়ে বললাম, ‘আপনাকে ওয়েলকাম ফেসবুকে।’
উনি এ বার বললেন, ‘ছিঃ বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে এই এক তোমাদের হয়েছে জগাখিচুড়ি ভাষা। হয় বাপু বাংলায় টাইপ করে লেখো অথবা ইংরেজিতে লিখে ইংরেজি কথায় বল।’ আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছেন, মনে রাখব আপনার কথা।’
ও দিক থেকে উত্তর এল, ‘আজকাল আমার গানগুলো কেমন বিকৃত স্বর ও সুরে সকলে গাইছে। এমনটি আমি আশা করিনি।’
আমি বললাম, ‘ওটা যুগধর্ম। এখনকার প্রজন্ম ইম্প্রোভাইজেশন পছন্দ করে। কিছুই করার নেই। মেনে নিন। সংস্কৃতি ভাঙে, গড়ে। আপনার রচনা, সাহিত্যসংস্কৃতি যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে। এখনও সকলে পড়ছে রবীন্দ্রসাহিত্য। গাইছে রবীন্দ্রগান।’
উনি বললেন, ‘তা হয়ত পড়ছে, কিন্তু আমাকে ভাঙিয়েই তো ব্যবসা করে খাচ্ছে কত মানুষ।’
আমি বললাম, ‘আপনি তো মহাসমুদ্র। আপনার জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে কণা কণা করে সব রত্ন তুলে নিয়ে গেলেও কম পড়বে না। ছড়িয়ে দিন রবীন্দ্রনাথ। এক আঁচলা জল সমুদ্র থেকে নিলে সাগরের জল কোনও দিনও নিঃশেষিত হবে না। উদার হোন রবীন্দ্রনাথ। ওপেন সোর্সের যুগে সব কিছুই খোলা। যে যা পাচ্ছে নিক কুড়িয়ে বাড়িয়ে। আশীর্বাদ করুন, যেন তাই নিয়েই বাঙালি বেঁচে থাকে।’ ওপাশ থেকে তিনি নীরব।
আরও পড়ুন: ভালবাসা জানে রবি ঠাকুর
আমি বললাম, ‘আপনি দেখেছেন রাজ্য জুড়ে কত কত রবীন্দ্রপুজো হয় এই সময়? আপনার ভাল লাগে না? কী হল, চুপ করে রইলেন যে!’
এ বার উনি মুখ খুললেন, ‘সব অন্তঃসারশূন্য। দেখনদারি। হুজুগ। হিড়িক যাই বল।’
আমি বললাম, ‘কেন কেন? কি দারুণ রবীন্দ্রকথায়, স্মৃতিতে, গানে, ভাষ্যে আপনার জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালিত হয়।’
উনি বললেন, ‘My brand is getting diluted now. I mean Brand Dilution.’
আমি বললাম, ‘সেটা ঠিক, তবে এখনও কচিকাঁচারা কি চমত্কার আবৃত্তি করে। শিশু ভোলানাথ থেকে সঞ্চয়িতা, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ থেকে লুকোচুরি। বাচিক শিল্পীরা করে খায়। নাট্যমঞ্চ ভরে ওঠে।’
অলঙ্করণ: অর্ঘ্য মান্না।
‘সে তো ভাল কথা। কিন্তু কত তথ্যবিকৃতি দেখি রবীন্দ্র অনুরাগীদের গবেষণায়। বুকটা ফেটে যায় আমার। আমাকে জড়িয়ে কত বিকৃত রুচির সাহিত্যসৃষ্টির কথা শুনি।’
‘আহ রাগ করবেন না। আমি বললাম। সবই কালের মায়া।’
এ বার উনি ও দিক থেকে একটি স্মাইলি পাঠালেন আমাকে। আমি তো অভিভূত হলাম। এ রবীন্দ্র তো প্রযুক্তির খুঁটিনাটি শিখে ফেলেছেন বেশ! প্রতি উত্তরে আর একটি স্মাইলি নমস্কার পাঠালাম তাঁকে।
‘তোমাদের এই নব্য প্রযুক্তির ধারাতে কোনও আন্তরিকতা নেই।’ বললাম, ‘মানে?’
উনি বললেন, ‘মানে যতই আমি বলি না কেন, ‘কাছে থেকে দূর রচিল’ অথবা ‘তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়’, কিন্তু সাক্ষাতের আলাপে, আড্ডায় যে মাদকতা আছে সেটা কি তোমাদের এই অনর্গল, অদেখা আলাপে হয়? তোমার কী মত?’
আরও পড়ুন: সে কালের চিনে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা
আমি বললাম, ‘আপনিই তো বলেছিলেন, ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই, যে রয় মনে আমার মনে।’ আলাপে যদি মনের মিল হয় আর ভাল লাগে, সেই আলাপচারিতায় কি প্রয়োজন সাক্ষাতে? এই তো বেশ। যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে...অহোরাত্র কাছে থেকেও তো মানুষ মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়।’
ও দিক থেকে তিনি তাঁরই একটি গানের লাইন পাঠালেন টাইপ করে।
আমি বেশ মজাও পাচ্ছিলাম আবার এক অনাবিল আনন্দে মনটা যেন ভরে উঠেছিল। ভাবছিলাম যদি সত্যি এমন হত? রবীন্দ্রনাথ ফেসবুকে ধরা দিতেন? হঠাৎ দেখি আমার নেট কানেকশন নেই। এমন হয়েই থাকে। তাই সবুজ বাতিঘরের দৃশ্যমান আলোটি জ্বলছে না আর। কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, আমার সেলফোনে একটি মেসেজ এল আর সেই সঙ্গে আমাদের গোটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের পাওয়ার কাটে জায়গাটায় নিঝুম, নিশুতি অন্ধকার নেমে এল। আমার আঁধার ঘরের একফালি আয়তাকার নীল এলইডি স্ক্রিনে আমি তখনও সেই রবাহুত, অনাহুত অতিথির চ্যাট বক্স খুলে পড়েই চলেছি বারে বারে। মোবাইলটা অন করে দেখি, ফেসবুক থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে শান্তিনিকেতন থেকে।
তারই নোটিফিকেশন এসে পড়ে রয়েছে কিছু ক্ষণ আগে।
পরের দিন ছিল বাইশে শ্রাবণ। কিছু পরে জেনেছিলাম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy