সমুদ্রে নামার একমাত্র পথের এরকমই হাল, সেখান দিয়েই নামে ভ্যান, নামেন পর্যটকেরাও।
উত্তাল সমুদ্র আর বেসামাল হাওয়া— সেই ঝাপটায় খানিকটা মুক্তির স্বাদ। সে জন্যই গত এক দশকে বাঙালি পর্যটকের কাছে ক্রমশ বেড়েছে মন্দারমণির আকর্ষণ। তাঁদের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে ব্যবসাও। আছে পর্যটন ঘিরে নানা প্রত্যাশা।
অথচ সদ্য পর্যটন মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নেওয়া মন্দারমণিতে নেই কোনও বাস্তব পরিকল্পনা। হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে যখন নাজেহাল হোটেল ব্যবসায়ীরা ঠিক তখনই নতুন নতুন ব্যবসার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে এই সৈকতাবাস।
সে সবের দিকে নজর নেই পুলিশ বা প্রশাসনের। দুপুরে বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে চলে সমুদ্র স্নান, প্যারা-গ্লাইডি বা জেট স্কিইং। তারই পাশে আমোদের অন্য আয়োজনও চলে দেদার। ছোট ছোট ছাতার নীচে ছক কেটে যায় রোদ। তারই মাঝখানে ধোঁয়ায় ঢাকা মাদকের আহ্বান। নিষিদ্ধ ‘হুক্কাবার’ হয়তো নয়, তবু মন্দারমণির বেলাভূমি এখন সেই আকর্ষণেরই কেন্দ্রভূমি। তা সে রাতে হোক বা দিনে। নবাবি মেজাজের নল-গড়গড়া আর অম্বুরি তামাক না থাকুক, মন-পসন্দ মদের সঙ্গে বুড়বুড়ি কেটে উঠে আসে নানা রকম মাদকের ধোঁয়া। এক রাতের বাদশা মন তখন যা চায়, তাই পাওয়া চাই।
বিপজ্জনক ভাবে মোটরগাড়ি চলাচল করে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে।
মন্দারমণির উপকূলেই রয়েছে একটি পুলিশ ক্যাম্প। কিন্তু তাদের কাজটা যে কী, সেটাই বুঝে পান না পর্যটকরা। বর্ধমান থেকে বেড়াতে আসা সুজিত দে খানিকটা ব্যাঙ্গের সুরেই বলেন, ‘‘ক্যাম্পের ভিতর যাঁরা আছেন তাঁরাও তো শুধু সাগরের হাওয়াই খাচ্ছেন বলে মনে হয়।’’ শুধু তাই নয়, গোটা মন্দারমণিতে কোথাও নেই একটি সাইনবোর্ড। মদ্য পান করে সমুদ্র স্নান যে নিষিদ্ধ সে বিধিসম্মত সতর্কীকরণের বার্তাটুকুও কেউ দেন না। নজরদারি তো দূর অস্ত।
১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্জন সমুদ্র সৈকত রাত্রিবেলায় সম্পূর্ণ অন্ধকার। কারণ এই এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। নেই কোনও সার্চ লাইটের ব্যবস্থাও। দিনের বেলায় যখন নীল সমুদ্রের উপর জড়ো হয় কালো মাথার সমুদ্র তখনও থাকেন না কোনও প্রশিক্ষিত নুলিয়া। তেমন কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে ঠিক কী হবে, জানেন না কেউই।
অথচ প্রতি বছর পযর্টকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা রোজগার হচ্ছে। আধুনিক পযর্টন কেন্দ্রের উপযোগী কোনও পরিকাঠামোই গড়ে উঠেনি। সড়ক, পরিবহণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানীয়জল, শৌচাগার— প্রায় কোনও পরিষেবাই নেই মন্দারমণিতে।
স্থানীয় কালিন্দী গ্রামপঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান অশোক মাইতির কথায়, “মন্দারমণি পযর্টনকেন্দ্র হিসেবে আজ যেটুকু গড়ে উঠেছে তা এলাকার হোটেল ব্যবসায়ীদের উদ্যোগেই। সরকার নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।” অশোকবাবুর অভিযোগ, কালিন্দী গ্রামপঞ্চায়েতের মন্দারমণি-সহ পাঁচটি মৌজা নিয়ে প্রায় ২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সৈকত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সম্ভাবনাময় এই সৈকত পযর্টন কেন্দ্রের আধুনিকীকরণের জন্য সরকারি মাস্টার প্ল্যান আজও তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
সৈকতে হুক্কা সেবন। —নিজস্ব চিত্র।
পর্যটকরাও মন্দারমণির এমন বেহাল পরিকাঠামো দেখে রীতিমত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। মন্দারমণিতে এখনও সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ পযর্টকই নিজস্ব গাড়িতে আসেন। তা না হলে দুর্ভোগে পড়তে হয়। দিঘা-কলকাতা সড়কে দিঘার কিছুটা আগে রামনগর ২ ব্লকের চাউলখোলা বাসস্টপে নামতে হয়। সেখান থেকে ইঞ্জিন রিকশা আর কয়েকটা ট্রেকারই ভরসা।
এরই সুযোগ নেন এক শ্রেণির অসাধু চালক। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই পযর্টকদের কাছ থেকে দ্বিগুণ বা তিন গুণ ভাড়া আদায় করেন তাঁরা। এক সময় কাঁথি থেকে দাদনপাত্রবাড় পর্যন্ত দু’টি বেসরকারি বাস চলত। কিন্তু তা বন্ধ।
এ দিকে যাঁরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসেন তাঁদের পড়তে হয় অন্য সমস্যায়। গাড়ি নিয়ে সস্ত্রীক মন্দারমণি বেড়াতে এসেছিলেন কলকাতার তরুণ ব্যবসায়ী রাজকুমার মোদক। যে হোটেলে উঠেছিলেন সেখানে নেই গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ফলে তা নিয়ে হেনস্থার চূড়ান্ত। রাজকুমারবাবুর ক্ষোভ, ‘‘দু’একটি হোটেল ছাড়া প্রায় কোনও হোটেলেই গাড়ি রাখার জায়গা নেই। তাহলে আমরা আসব কী করে? বাস কি ট্রেনের ব্যবস্থাও তো নেই।’’
সে কথা সত্যি। অধিকাংশ হোটেলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ নিয়ম না মেনেই নির্মাণ করেছেন মালিক। তার উপর গাড়ি রাখার জায়গা তৈরি করা যায়নি। এ দিকে রাস্তা না থাকায় যথেচ্ছ গাড়ি চলাচল নিয়েও ছিল বিতর্ক।
আবার গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে বেলা ভূমির সর্বনাশ করেছেন এই পর্যটকরাই। একদা বিস্তীর্ণ বেলাভূমি জুড়ে ছড়িয়ে থাকত লাল কাঁকড়া, যেন সারা বছর পলাশের মেলা। কিন্তু এখন এ তটে আর দেখা যায় না লাল কাঁকড়ার মিছিল। স্থানীয় এক রিকশা চালকই বললেন, ‘‘কেমন করে দেখা যাবে? গাড়ি চলে যে। কাঁকড়ারা বালি ফুঁড়ে ওপরে উঠতে চায় না।’’ গা়ড়ি চলাচলের ফলে বহু কাঁকড়া মারাও পড়ে। সৈকত সুরক্ষা সমিতির সভাপতি ও কালিন্দী ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দীপক দাস অভিযোগ করেন, “সিআরজেড (কোস্টাল রেগুলেশন জোন) বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সৈকতের উপর দিয়ে অবাধ চলাচলে করে ভারী পণ্যবাহী লরি-সহ বিভিন্ন মোটরযান ও ইঞ্জিন রিকশা। তার জেরে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে লাল কাঁকড়ার দল।’’
আবার বিপদ থাকছে অন্য দিকেও। অতি উত্তেজিত পর্যটকরা, গাড়ি নিয়েই চলে যান সমুদ্রের একেবারে সামনে। ছোট-বড় নানা মাপের ঢেউ আছড়ে পড়ে গাড়ির উপর। যে কোনও ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে যে কোনও সময়। নেই ন্যূনতম নজরদারি। শুধু এ টুকুই নয়, এত পর্যটক যে সমু্দ্র বিলাসের জন্য আসেন, সেখানেও নেই স্বাচ্ছন্দ্য। মন্দারমণি সৈকতে নামার একমাত্র ঘাটটিও দীর্ঘদিন ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পযর্টকরা প্রায়ই ছোটখাট দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ সে সব দিকে কোনও নজর নেই প্রশাসনের।
ছবি: সোহম গুহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy