Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

বাঙুরের ভুলের ফাঁদে বিপন্ন অ্যাসিড-আক্রান্ত মহিলা

ট্রেনে দুষ্কৃতীর অ্যাসিড-হামলায় এমনিতেই তাঁর দুর্গতির শেষ নেই। তার উপরে অ্যাসিড-দগ্ধ মহিলাটির বিপন্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে কলকাতারই এক সরকারি হাসপাতালের ভুল।

কলকাতা
দীক্ষা ভুঁইয়া শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৮
Share: Save:

ট্রেনে দুষ্কৃতীর অ্যাসিড-হামলায় এমনিতেই তাঁর দুর্গতির শেষ নেই। তার উপরে অ্যাসিড-দগ্ধ মহিলাটির বিপন্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে কলকাতারই এক সরকারি হাসপাতালের ভুল।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, যে-হাসপাতালে অ্যাসিড-আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা হবে, ছাড়ার সময়ে ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে ‘অ্যাসিড-আক্রান্ত’ কথাটি লিখে দিতে হবে সেখানকার কর্তৃপক্ষকে। পরে সেই সার্টিফিকেট দেখালে রাজ্য বা কেন্দ্রের অধীন যে-কোনও হাসপাতালে বিনা খরচে প্লাস্টিক সার্জারি বা অন্য চিকিৎসার সুযোগ পাবেন আক্রান্ত ব্যক্তি। এবং সেই সার্টিফিকেট দেখেই রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে।

অথচ এম আর বাঙুরের মতো হাসপাতাল অ্যাসিড-আক্রান্ত এক মহিলার চিকিৎসার পরে ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে ‘অ্যাসিড বার্ন’ কথাটির বদলে লিখেছে ‘কেমিক্যাল বার্ন’। এর জেরে রোগিণী পরবর্তী ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন বলে জানাচ্ছে চিকিৎসক মহলই। তাদের বক্তব্য, এই ধরনের ভুল তথ্য দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ না-ও মিলতে পারে।

ঠিক কী ঘটেছিল?

১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার লোকালে বাড়়ি ফেরার পথে অ্যাসিড-হামলার শিকার হন বছর চব্বিশের এক তরুণী এবং তাঁর পাশে বসে থাকা এক মহিলা। অভিযোগ, তরুণীকে লক্ষ করে অ্যাসিড ছুড়ে দিয়েই নেমে পালায় এক দুষ্কৃতী। তরুণীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর পাশের মহিলাও জখম হন। কল্যাণপুরের বাসিন্দা, পেশায় আয়া ওই মহিলার মাথায়, মুখে, দু’হাতে অ্যাসিডের ছিটে লেগেছে। দু’জনকেই প্রথমে বারুইপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তরুণীকে পাঠানো হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এবং অন্য মহিলার ঠাঁই হয় এম আর বাঙুর হাসপাতালে। কিন্তু ১৬ তারিখে ওই মহিলাকে ছেড়ে দেওয়ার সময়ে ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে ‘অ্যাসিড বার্ন’ কথাটির বদলে ‘কেমিক্যাল বার্ন’ লেখা হয়েছে। ফলে পরে অন্য সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়বেন বলে মনে করছেন অনেক চিকিৎসক এবং আইনজীবী। এমনকী মহিলার প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ না-ও মিলতে পারে।

প্রশ্ন উঠছে, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ জেনেও বাঙুর হাসপাতাল এই ভুল করল কী করে? ওই মহিলাকে লক্ষ করে অ্যাসিড ছোড়া হয়নি বলেই কি হাসপাতাল এই ভুল করল?

জবাব মিলছে না। একাধিক অ্যাসিড-আক্রান্তের মামলা লড়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের কৌঁসুলি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কাউকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লে তা যদি অন্য কারও গায়ে লাগে, তা হলে কি দ্বিতীয় ব্যক্তি ‘ভিকটিম’ বা আক্রান্ত নন? তিনি যদি আক্রান্ত বলে গণ্য হন, তা হলে নিশানার লোকটি ব্যক্তি ছাড়াও অন্য কারও গায়ে অ্যাসিড লাগলে তাঁকেও বলতে হবে ‘অ্যাসিড-আক্রান্ত’। এ ক্ষেত্রে তো সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।’’

ওই আইনজীবীর অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ প্রতিটি হাসপাতাল ও পুলিশের জানার কথা। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে আক্রান্তেরা গাফিলতির শিকার হন এবং পরবর্তী কালে ক্ষতিপূরণ তো দূর অস্ত্‌, চিকিৎসার পয়সাও ফেরত পান না।

বাঙুর হাসপাতালের সুপার তাপস ঘোষের বক্তব্য, ‘কেমিক্যাল বার্ন’ কথাটি লেখার জন্য ক্ষতিপূরণ পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্যে এই বিষয়ে সংশয় বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, ‘‘হাসপাতাল ‘অ্যাসিড বার্ন’ না-লিখে কেন ‘কেমিক্যাল বার্ন’ লিখল, জানি না।’’ ওই মহিলা সুযোগ-সুবিধা পাবেন কী ভাবে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।

এখানেই শেষ নয়। হাসপাতালে ভর্তির পরেই রক্ত পরীক্ষার জন্য ওই মহিলার পরিবারকে টাকা জোগাতে হয়েছে এবং ওষুধপত্রও কিনে দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ। অথচ শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, সরকারি বা বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতালেই অ্যাসিড-আক্রান্তের চিকিৎসা করতে হবে বিনা পয়সায়। তা সত্ত্বেও বাঙুরে ওই মহিলার পরিবারের কাছ থেকে নানা খাতে টাকা নেওয়ার অভিযোগে চিকিৎসক মহলের একাংশ বিস্মিত।

এমনকী ওই রোগিণীর ছুটির সময়ে হাসপাতাল থেকে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে নিতে বলা হয়। প্রথম রাতে তাঁর কাছে আয়া রাখার জন্যও মহিলার আত্মীয়দের টাকা দিতে বাধ্য করানো হয় বলে অভিযোগ। পরে ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’ সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওই হাসপাতালের সুপারের সঙ্গে কথা বলেন। সুপার তার পরে আয়ার খরচ মকুব করেন। কিন্তু পরের দিন থেকে আর কোনও আয়াই ওই মহিলার কাছে থাকতেন না বলে অভিযোগ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE