Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Dev on Kunal Ghosh

দেব বনাম কুণাল, না কি তৃণমূল! বিতর্কের প্রজাপতি কি সাংসদের রাজনৈতিক জীবনেও ডানা ঝাপটাবে?

টুইট করেছিলেন দেব। উস্কে দিয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। ঘি ঢালেন কুণাল ঘোষ। তার পরে দেব প্রতিক্রিয়া দিতেই আরও আক্রমণাত্মক কুণাল। ‘প্রজাপতি’ বিতর্কে রাজনীতির ছায়া ক্রমশ বাড়ছে।

Dev

প্রজাপতি বিতর্ক বাড়ছে। — ছবি: দেবের ফেসবুক পেজ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:২৫
Share: Save:

পর পর দু’বার ঘাটাল থেকে সাংসদ হয়েছেন দীপক অধিকারী। তবে নিজের কাছে সাংসদের চেয়েও বড় পরিচয় অভিনেতা ‘দেব’ হিসাবেই। রাজনীতিতে তাঁর অনীহা আগেও প্রকাশ্যে এসেছিল। এ বার তাঁর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘প্রজাপতি’ নিয়ে বিতর্ক সেই জল্পনা নতুন করে উস্কে দিয়েছে। নিজের দলের নেতা কুণাল ঘোষের সঙ্গে দেবের কথার লড়াই যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে— ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেবকে কি তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে দেখা যাবে?

ঘটনাচক্রে, দেব নিজে আর লোকসভা ভোটে লড়তে খুব একটা আগ্রহী নন। সেকথা তিনি প্রকাশ্যে বলেওছেন। বরং তিনি বেশি আগ্রহী অভিনেতা হিসেবে নিজেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁর অভিনেতা পরিচয়ের সঙ্গেই ‘নেতা’ পরিচয়টিও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে। ফলে তিনি যা-ই করুন, রাজনীতি তাঁকে ছাড়ছে না।

সাম্প্রতিক বিতর্কের শুরু অধুনা বিজেপি নেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে তৈরি দেবের ছবি ‘প্রজাপতি’ নন্দন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সুযোগ না পাওয়া নিয়ে। গত শুক্রবার একই দিনে তিনটি বাংলা ছবি মুক্তি পায়। অভিজিৎ সেন পরিচালিত ‘প্রজাপতি’-র প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় ছাড়াও দেব ছবির সহ-প্রযোজক। একই দিনে মুক্তি পাওয়া ‘হামি-২’ এবং ‘হত্যাপুরী’-র অভিনেতা থেকে প্রযোজনা কোনও কিছুতেই অবশ্য রাজনীতির যোগ নেই। বাকি দু’টি ছবি সরকারি প্রেক্ষাগৃহ নন্দনে জায়গা পেয়েছে। ‘প্রজাপতি’ পায়নি। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, শনিবার দেব একটি টুইট করেন, ‘‘এ বার তোমায় মিস্ করব নন্দন। কোনও ব্যাপার নয়, আবার দেখা হবে। গল্প শেষ।’’

সেটি নিয়ে প্রথম ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন’ তোলেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। তিনি সটান বলেন, ‘‘যেন বাপের সম্পত্তি! পার্টির সম্পত্তি! মিসইউজ চলছে। যাদের নামে লোক হলে আসে, তাদের দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। রাজ্যের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী। বহুদিন পর একটা বাংলা ছবি করলেন। লোকে মুখিয়ে আছে। এত সুন্দর হল। সেখানে শো দেওয়া হল না।’’ দিলীপের সংযোজন ছিল, ‘‘যেহেতু মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপিতে আছেন, তাই তাঁকে বয়কটের চেষ্টা হচ্ছে।’’ সেই প্রসঙ্গেই ঘাটালের সাংসদ দেবের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তৃণমূলের সমালোচনা করেন মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ। বলেন, ‘‘রাজনীতি যা-ই করুন, দেব বাংলা সিনেমার একটা বড় অংশকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাঁকে তারা ইউজ করছে। রোজ। জোর করে টিকিট দিয়ে এমপি করেছে! না হলে ওঁর সিনেমার রিলিজ তখন বন্ধ করে দিয়েছিল।’’

বিষয়টি দ্রুত ধরে নেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি সোমবার বলেন, ‘‘রাজনীতির বাইরেও একটা সমাজ আছে। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি আছে। তাঁদের নিজস্ব কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে। এগুলো তো দিলীপবাবু জানেন না! দিলীপবাবু শুধু জানেন গোয়াল, সেই গোয়ালের গরুর দুধ থেকে সোনা।’’ পাশাপাশিই কুণাল বলেন, ‘‘এই সিনেমায় দেবের অভিনয় দারুণ। বিশেষ করে এই যে বাবা-ছেলের রসায়ন। ‘টনিক’-এ দেব আর যেটা পরাণবাবু (প্রবীণ অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি ব্যক্তিগত জীবনে বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী) ছিলেন। পরাণবাবু সুপারহিট। আর এখানে ডুবিয়ে দিয়ে গিয়েছে মিঠুনদা। মিঠুনদাকে ১০ গোল দিয়ে দিয়েছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে এই জায়গা থেকে ছবিটাকে টানার জন্য হয়তো কোনও বিতর্ক তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি।’’

দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানান দেব। তিনি বলেন, ‘‘কুণাল’দা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তবে একটাই কথা বলব, উনি রাজনৈতিক মুখপাত্র। আমার মনে হয় সিনেমা নিয়ে ওঁর পড়াশোনা নেই। আমি ওঁকে ছোট করে কিছু বলতে চাইছি না। যথেষ্ট সম্মানীয় একজন মানুষ। তবে আমি মনে করি, সিনেমাটা আমার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।’’

নন্দনে জায়গা না পেলেও রাজ্যের সর্বত্রই হলে হলে পৌঁছে গিয়েছে ‘প্রজাপতি’। কুণাল ছবিটি ‘হিট’ করেনি বলে দাবি করলেও ডিস্ট্রিবিউটরদের হিসাব বলছে, গত শুক্রবার মুক্তিপ্রাপ্ত বাকি দু’টি ছবির তুলনায় এখনও পর্যন্ত দেবের ছবির প্রতিই দর্শকদের টান বেশি। প্রসঙ্গত, নন্দনে যে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ আছে, তার দু’টিতে ‘হামি ২’ এবং ‘হত্যাপুরী’ চললেও তৃতীয়টিতে চলছে ‘দোস্তজী’। সেটি নতুন ছবি নয়। ঘটনাচক্রে, নন্দনে ছবি মুক্তি নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে। ঘোষিত ‘তৃণমূল-বিরোধী’ অনীক দত্তের পরিচালিত ছবি ‘অপরাজিত’-কে নন্দনে জায়গা দেওযা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেই সূত্রেই মনে করা হচ্ছে, এ বার ‘প্রজাপতি’-র প্রতি সেই ‘বিমাতৃসুলভ’ মনোভাব দেখানো হল মিঠুনের কারণে।

দেবের ঘনিষ্ঠেরা জানেন, তাঁর আর মিঠুনের রাজনৈতিক পরিচয়জনিত দ্বন্দ্বে ‘প্রজাপতি’র উড়ান বন্ধ হোক, দেব তা একেবারেই চাইছেন না। এই বিষয়ে তিনি এতটাই ‘স্পর্শকাতর’ যে, মিঠুন এবং তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গে কোনও প্রশ্ন করা হলে প্রকাশ্যে তার জবাব নিয়েও সতর্ক থাকছেন তৃণমূলের সাংসদ।

কিন্তু কুণালের সম্পর্কে দেবের মন্তব্য আবার জলঘোলা করে। কুণাল মঙ্গলবার আবার বলেন, ‘‘দেব স্পষ্ট করে মনের কথা বলতে পারছে না। খুব ভাল ছেলে। ওকে আমি ভালবাসি। এটা ঠিক যে, ও আমার থেকে সিনেমাটা বেশি বোঝে। তবে সবটা বুঝলে তো সব সিনেমাই হিট করবে! সেটা তো হয় না। সব ব্যাটসম্যান যদি সবটা বুঝে যেতেন, তা হলে প্রতি ম্যাচে সেঞ্চুরি করতেন। শূন্য রানে কেউ আউট হতেন না। তেমনই সব সিনেমা হিট করে না। ফ্লপও হয়। তাই সেটা যখন হয়, তখন দেবের সকলের মতই শোনা উচিত।’’ অতঃপর দেব হাতজোড় করে বলেন, ‘‘মানুষ ছবিটা দেখছেন। দয়া করে বিতর্ক তৈরি করবেন না। কেউ মিঠুনদার পক্ষ নিচ্ছেন। কেউ আমার পক্ষ নিচ্ছেন। তাতে মানুষ ভয় পেলে মিঠুনদার ক্ষতি হবে, আমারও ক্ষতি হবে। সর্বোপরি বাংলা ছবির ক্ষতি হবে।’’

যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিবৃতি এবং বিতর্কের জল গড়ানো বন্ধ হল। কিন্তু অনেকে বলছেন, এর প্রভাব আরও ‘সুদূরপ্রসারী’ হতে পারে। যার আঁচ পড়তে পারে সাংসদ দেবের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে। যাঁরা তা ভাবছেন, তাঁদের অভিমত, এই লড়াই আসলে দেব বনাম কুণাল নয়। এই লড়াই আসলে দেব বনাম ‘নতুন’ তৃণমূলের। অতীতেও ছবি নিয়ে শাসকের সঙ্গে দেবের সংঘাত দেখা গিয়েছে। আর অন্যান্য বারের মতো এ বারেও দেব জানিয়ে দিয়েছেন, সুযোগ পেলে ফের মিঠুনকে নিয়ে তিনি ছবি করবেন। এ সব দেখেশুনেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেব কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। কারণ, তিনি যে রাজনীতিতে আর আগ্রহী নন, তা ২০২১ সালের ডিসেম্বরেই আনন্দবাজার অনলাইনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন দেব। বলেছিলেন, ‘‘যদি সম্ভব হয়, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে আর দাঁড়াতে চাই না।’’

সারা বাংলা জানে, দেব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। তাঁর ইচ্ছেতেই রুপোলি পর্দার নায়ক রাজনীতির ময়দানে নেমেছিলেন। আনন্দবাজার অনলাইনের সেই সাক্ষাৎকারে দেবও স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘‘আমি শুধু একটা মানুষকেই ভালবাসি। তিনি হলেন মমতা’দি। তাঁর জন্যই আমি এত দিন পার্টিতে আছি। দিদিকে অনেক বারই বলেছি। দিদির সঙ্গে আমার একটা অন্য সম্পর্ক। সেখানে দিদিকে ‘না’ বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ পাশাপাশিই রাজনীতির প্রতি তাঁর অনীহার কথা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘ফিল্মের চেয়ে রাজনীতির ময়দানে অভিনেতার সংখ্যা অনেক বেশি! আমি এমন দেখেছি যে, বোঝা যাচ্ছে না, উত্তমকুমার ভাল অভিনেতা নাকি ওঁরা! কখনও কখনও এটা বুঝতে গিয়েই মুশকিলে পড়ে যাই।’’ সেখানেই না থেমে বলেছিলেন, ‘‘২০১৪ সালে যখন রাজনীতিতে এসেছিলাম, তখন আর ২০২১-এর মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। রাজনীতি অনেক পাল্টে গিয়েছে। রাজনীতিতে এখন ‘রাজ’ আছে। কিন্তু ‘নীতি’ হারিয়ে গিয়েছে। আদর্শ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy