আক্রমণের অভিমুখ ঘুরে যাওয়ার অভিযোগ বিজেপির অন্দরেও। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লড়াই তো দলের বিরুদ্ধে দলের! কিন্তু তা একের বিরুদ্ধে একের হয়ে উঠছে কেন?
বিজেপির অন্দরে এমন প্রশ্ন নতুন নয়। কিন্তু ইদানীং সেটা বেড়ে গিয়েছে। সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিধানসভার বিরোধী দলনেতার আক্রমণের ঝাঁজ বেড়েই চলেছে। অভিষেক যেখানেই সভা করছেন, সেখানেই পাল্টা সভা করতে যাচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী। বক্তব্যের ৮০ ভাগ জুড়ে থাকছে অভিষেককে আক্রমণ। কখনও ‘চোর’, কখনও ‘তোলাবাজ’ আর সব সময় ‘ভাইপো’ সম্বোধন। যা বিজেপির অন্দরে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ বিধানসভার বিরোধী দলনেতাকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘অভিষেক-বিরোধী দলনেতা’ বলে।
শুভেন্দু নিজে অবশ্য মানতে চান না যে তিনি শুধু অভিষেককেই ‘টার্গেট’ করেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘উনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নন। কারণ, উনি যাঁর আলোয় আলোকিত আমি তাঁকেই নন্দীগ্রামে হারিয়েছি।’’ বিরোধী দলনেতার আরও বক্তব্য, ‘‘উনি যেখানে সভা করেন, আমি সেখানে যাই, এটা ঠিক নয়! বরং, আমি যেখানে সভা করে আসি সেখানেই তৃণমূল পাল্টা সভা করে। যেমন আমি রানাঘাটে সভা করে এসেছি। তৃণমূল পাল্টা করছে। হাজরাতেও তাই হয়েছে।’’ বস্তুত, আনন্দবাজার অনলাইনকে উত্তর দেওয়ার সুযোগেও অভিষেককে আক্রমণ করেছেন শুভেন্দু। বলেছেন, ‘‘আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আর ওঁর লড়াইটা হচ্ছে বেআইনি অর্থ, মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে। তাই আমার ব্যক্তিগত আক্রমণ করার প্রশ্নই আসে না।’’
তথ্য বলছে, সম্প্রতি কাঁথি এবং রানাঘাটে সভা করেছেন শুভেন্দু। ঘটনাচক্রে, তার কয়েক দিন আগেই সেখানে সভা করেছিলেন অভিষেক। লড়াই মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল গত ৩ ডিসেম্বর। সে দিন কাঁথিতে শুভেন্দুর বসতভূমিতে সভা ছিল অভিষেকের। আর শুভেন্দুর সভা ছিল অভিষেকের কর্মভূমি ডায়মন্ড হারবারে। সেই দ্বৈরথের দিনেই বিজেপির অন্দরের কথা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে বরাবর মুখর দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘প্রচার দেখে মনে হচ্ছে, রাজ্যে দুটো পরিবার আর দুটো মানুষের লড়াই ছাড়া আর কিছু নেই! রাজনীতি রাজ্যের ১০ কোটি মানুষকে নিয়ে। রাজনীতি সে ভাবেই হওয়া উচিত। রাজনীতিকে ড্রামায় পরিণত করার কোনও মানে হয় না।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অবশ্য দিলীপের মতো ‘ঠোঁটকাটা’ বলে পরিচিতি নেই। তিনি শুভেন্দু-অভিষেক লড়াই প্রসঙ্গে কিছুটা নরমও। তবে তাঁরও সম্মতি নেই ‘ব্যক্তি লড়াইয়ে’। সুকান্তের কথায়, ‘‘বিজেপি আদর্শগত লড়াই করে। আমরা তৃণমূলের সার্বিক দুর্নীতি, রাজ্যের অনুন্নয়ন, সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরোধিতা করি। কোনও ব্যক্তি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তবে ব্যক্তি বাদ দিয়ে তো রাজনীতি হয় না। তাই সব কিছুর মাথায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের আক্রমণ করতেই হয়।’’
তবে রাজ্য সভাপতি যা-ই বলুন, ইদানীং বিজেপির অন্দরেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সাধারণ ভাবে বিরোধী দলনেতার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। শুভেন্দুর ক্ষেত্রে তা আরওই প্রত্যাশিত। কারণ, তিনি মুখ্যমন্ত্রীকেই ভোটে হারিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তাঁর রাজনৈতিক আক্রমণের অভিমুখ ঘুরে যাচ্ছে এমন এক জনের দিকে, যিনি রাজ্য বিধানসভার সদস্যও নন। প্রকাশ্য এ কিছু না বললেও অনেকে মনে করছেন, এই ‘ব্যক্তিগত’ লড়াইয়ের ফলে আগামী পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে সমস্যা হতে পারে। মোদী সরকারের সাফল্য ও তৃণমূলের ব্যর্থতা তুলে ধরার বদলে যে ভাবে ব্যক্তি আক্রমণ চলছে, তা দলের নীতি নয়। রাজ্যে দলের ‘অন্যতম মুখ’ শুভেন্দু অভিষেকের বিরুদ্ধে লাগাতার তোপ দেগে চলায় অনেকেই প্রভাবিত হয়ে সেই স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন। তাতে আদতে দলের ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, অভিষেকের মাধ্যমে পাতা তৃণমূলের ‘ফাঁদে’ পা দিয়ে ফেলছেন শুভেন্দু। ফলে বিজেপি লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে। শুভেন্দুও ‘অভিষেক সরণি’-তে আটকে পড়ছেন।
সন্দিগ্ধরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে চাইছেন, রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘরে ডেকেছিলেন শুভেন্দুকে। সঙ্গে অনেকে থাকলেও এবং সাক্ষাৎ সামান্য সময়ের জন্য হলেও তা নিয়ে প্রচুর জল্পনা তৈরি হয়। বিতর্ক তৈরি হয় শুভেন্দুর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করায়। বিরোধী দলনেতা যদিও প্রাণপণে তা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানিয়েছেন, সিনিয়র রাজনীতিক হিসেবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বয়ঃকনিষ্ঠ রাজনীতিক শুভেন্দু পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই পারেন। সেটাই সৌজন্য। কিন্তু মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাৎ নিয়ে জল্পনা তাতে থামেনি। যা খণ্ডাতে শুভেন্দুকে এমনও বলতে হয়েছিল যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ‘ফাঁদে’ ফেলতে চেয়েছিলেন ঘরে ডেকে নিয়ে। তিনি সঙ্গে আরও কয়েক জন বিধায়ককে নিয়ে গিয়ে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তবে তাতেও জল্পনা থামেনি। অত্যুৎসাহীরা দিনক্ষণ মিলিয়ে বলতে শুরু করেছেন, তার পর থেকেই নাকি অভিষেককে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু।
রাজ্য বিজেপিতে ‘শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিতেরা অবশ্য তা মানতে চান না। তাঁদের মধ্যে এক জনের বক্তব্য, ‘‘দাদা আগেও যেমন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এখনও তাই রয়েছেন। অভিষেক তো আর তৃণমূলের বাইরে নন! এখন তো সরকার, দল সবই তিনি চালান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই আছেন। আর মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেন্দু’দা ভোটের লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছেন। এর পরেও যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরা মুর্খের স্বর্গে বাস করেন। বিজেপির লড়াই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সেটাই তো দাদার প্রধান স্লোগান।’’
তবে ইতিহাস বলছে, মমতার তুলনায় বরাবরই অভিষেকের বিরুদ্ধে শুভেন্দুর ক্ষোভ বেশি। অভিষেকের কারণেই তৃণমূলের তৎকালীন যুব সভাপতি শুভেন্দুকে ‘কোণঠাসা’ হতে হয়েছিল। শুভেন্দুকে আটটি জেলার পর্যবেক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যেও ছিলেন অভিষেকই।
তার জেরেই কি এই আক্রমণ? না কি তৃণমূলের ‘আগামী’ হিসাবেই অভিষেককে প্রধান লক্ষ্য করেছেন শুভেন্দু? আপাতত সেই জল্পনায় মশগুল বিজেপি। মশগুল তৃণমূলও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy