শিল্প মানে যে শুধু কাঠ-সিমেন্ট-লোহা নয় তা প্রায়ই বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনোদন জগত তথা ফিল্ম-টিভি-যাত্রা-নাটকের মতো কলাশিল্পকেও শিল্পের পংক্তিভুক্ত করে থাকেন। কিন্তু বিনোদনকে কেন্দ্র করেও কী ভাবে বিনিয়োগ টানা যায়, সেটা খাস কলকাতায় উজিয়ে এসে দেখিয়ে দিয়ে গেল সেই গুজরাতই। সে রাজ্যের বিভিন্ন লোকেশনে অবাধে শ্যুটিং করার আহ্বান জানিয়ে বাংলার পরিচালক-প্রযোজকদের কাছে দরবার করে গেলেন গুজরাতের পর্যটন-কর্তারা।
বেশ ক’বছর ধরে বাংলায় শ্যুটিং করার ছাড়পত্র আদায়ে ‘এক জানলা’-পদ্ধতি চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। সে ভাবনা এখনও ভাবনার স্তরেই আছে। গুজরাত কিন্তু ইতিমধ্যেই ‘ফিল্ম ট্যুরিজম সেল’ গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন লোকেশনে নির্দিষ্ট চাহিদা-সহ শ্যুটিংয়ের আর্জি জানিয়ে এই সেলকে একটি আবেদন পাঠানোই যথেষ্ট। কলকাতায় এসে গুজরাত পর্যটন ও ফিল্ম ট্যুরিজম সেল-এর বিপণন আধিকারিক কিংশুক বিশ্বাসের দাবি, ‘‘স্রেফ একটি চিঠিই মুশকিল আসান করবে। সাত দিনেই মিলবে ছাড়পত্র।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘না-এলেও ক্ষতি নেই। ধরে নিন এমনিই অনুমতি দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’’ হেরিটেজ স্মারক বা অভয়ারণ্য ছাড়া অন্য যে কোনও লোকেশনে এ ভাবেই ছাড়পত্র মিলবে। শুধু টালিগঞ্জ নয়, গোটা দেশের চিত্রপরিচালক-প্রযোজকদের কাছেই এ ব্যবস্থা স্বপ্নের মতো। ‘কুছ দিন তো বিতাইয়ে গুজরাত মে’-র মতো জনপ্রিয় ক্যাম্পেনের পর পর্যটনে আরও জোর দিতে এখন সিনেমাকেই হাতিয়ার করতে চাইছে গুজরাত। কিংশুকবাবুর কথায়, ‘‘ছবিতে গুজরাতকে দেখানো মানেই তো রাজ্যের প্রচার। সিনেমা দেখে আরও বেশি পর্যটক গুজরাতে আসতে চাইবেন।’’ ‘লগানে’ কচ্ছ এলাকার ঊষর পটভূমি কিংবা ‘হম দিল দে চুকে সনমে’র চোখ জুড়োন হাভেলি— সবই শ্যুট হয়েছে গুজরাতে।
গুজরাত পর্যটনের ওয়েবসাইটেই এখন থেকে আলাদা করে ফিল্ম ট্যুরিজমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যে শ্যুটিংয়ের সম্ভাব্য লোকেশন-তালিকা থেকে শুরু করে গুজরাত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ডিরেক্টরিও দ্রুত ওয়েবসাইটের অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়েছে। কিংশুকবাবু বলছিলেন, ‘‘দু’মাসের মধ্যে গুজরাতে ভিন রাজ্য থেকে আসা শ্যুটিং ইউনিটের জন্য স্টুডিও, আলোর সরঞ্জাম বা জুনিয়র আর্টিস্টের তালিকা, ফোন নম্বর সব ওয়েবসাইটেই মজুত থাকবে।’’ যদি একসঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলায় শ্যুটিংয়ের দরকার হয়, তা হলেও একাধিক জায়গায় যোগাযোগ করতে দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না। ফিল্ম ট্যুরিজম সেলই সবার মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে বিষয়টি দেখবে। এ ছাড়া, যে কোনও প্রকাশ্য স্থানে শ্যুটিংয়ের দেখভালের জন্য পুলিশ-প্রশাসন কোনও টাকা নেবে না বলেও গুজরাত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি হোটেলে ফিল্ম ইউনিটের জন্য ৫০ শতাংশ ছাড় মিলবে।
কিছু দিন আগেই আমদাবাদের আশপাশে ও কলকাতায় লম্বা শ্যুটিং-পর্ব উতরেছেন অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘পিকু’র পরিচালক সুজিত সরকার। সুজিতের ছবির প্রযোজক রনি লাহিড়ীও গুজরাতের টেনশনহীন শ্যুটিং-অভিজ্ঞতায় মুগ্ধ। বলছিলেন, ‘‘গুজরাতে গোটা পদ্ধতিটা একেবারেই সহজ-সরল। কলকাতাতেও স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সঙ্গে দারুণ সহযোগিতা করেছে। কিন্তু কলকাতায় অনেক বছর ধরে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কোথায় কী ভাবে যেতে হবে, তাতে আমরা পুরোদস্তুর সড়গড় ছিলাম! আনকোরা লোক হলে হয়তো আর একটু খোঁজখবর করতে হতো।’’ আদতে কলকাতার ছেলে, অধুনা মুম্বইবাসী বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ই যেমন এ শহরে কাজ করতে এসে সমস্যায় পড়েছেন। বৌদ্ধায়নের ছবি ‘তিন কাহন’-এর প্রযোজক মোনালিসা মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘মুম্বইয়েও শ্যুটিংয়ের ছাড়পত্র পেতে একাধিক জায়গায় যেতে হয়। কিন্তু কলকাতায় অহেতুক সময় লাগে।’’
এ কথাও ঠিক যে, গত কয়েক বছরে একাধিক বলিউড ছবি কলকাতা এবং এ রাজ্যের একাধিক জায়গাকে লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে। কহানি-খ্যাত পরিচালক সুজয় ঘোষ মনে করেন, ‘‘ঠিকঠাক পরিকল্পনা করে এগোলে কলকাতাতেও সুষ্ঠু ভাবে শ্যুটিং শেষ করা সম্ভব।’’ তবে সুজয়ের ছবির লাইন প্রোডিউসার অরিন্দম শীলই বলছেন, ‘‘কলকাতায় অনেককে ছাড়পত্র সংক্রান্ত নানা জটিলতায় ভালই ভুগতে হয়।’’ কহানি, গুন্ডে বা দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী-র মতো ছবি এ রাজ্যে শ্যুট করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অরিন্দমের সংস্থার। অরিন্দমের কথায়, ‘‘বাংলায় নির্ঝঞ্ঝাট এক-জানলা শ্যুটিং ব্যবস্থাপনার আশাতেই মুম্বইয়ের অনেক প্রযোজক-পরিচালক আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।’’ অরিন্দমের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে কথা হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর এমন পদ্ধতিতে সায়ও রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবকপ্রতিম তারকা প্রসেনজিতও এই গুজরাত ধাঁচের শ্যুটিং ব্যবস্থাপনার হয়ে সওয়াল করছেন। তিনি মনে করাচ্ছেন, বণিকসভা ফিকি-র পূর্বাঞ্চলীয় সম্মেলনে শ্যুটিংয়ের এককালীন ছাড়পত্র নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। বাংলার পর্যটন কর্তাদের ডেকেও বোঝানো হয়েছে।
কিন্তু দৃশ্যতই কাজের কাজ এখনও তেমন হয়নি। জেলার লোকেশন তো বটেই কলকাতা শহরের মধ্যেই লালবাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন গঙ্গার ঘাটে শ্যুটিংয়ের জন্য আলাদা জায়গায় হত্যে দিতে হয়। বাংলার পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলছেন, ‘‘কারও শ্যুটিংয়ের অনুমতি দেওয়ার এক্তিয়ার পর্যটন দফতরের নেই।’’ অথচ একা গুজরাত নয়, কর্নাটক, গোয়া, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং নবগঠিত তেলঙ্গানাও এখন ফিল্ম ট্যুরিজম সেল গড়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে। গুজরাতের পর্যটন-কর্তারাও বলছিলেন, আসল লক্ষ্য হল পর্যটন ব্যবসার প্রসার। বছরে ৪ লক্ষ পর্যটক এই বাংলা থেকেই পায় গুজরাত। গুজরাত থেকে বাংলায় আসা পর্যটকের সংখ্যা অবশ্য তার অর্ধেকেরও কম। ঠিক যেমন পর্যটন খাতে গুজরাতের বাজেট ৫০০ কোটি, বাংলায় তার অর্ধেকেরও কম (২২৩ কোটি)।
বহু বছর আগে ‘ভুবন সোম’ ছবিতে ভাগলপুরের নদীচর ফুটিয়ে তুলতে সৌরাষ্ট্রের নিসর্গে লোকেশন ফেলেছিলেন মৃণাল সেন। কয়েক মাসের মধ্যে টালিগঞ্জের প্রযোজক, পরিচালকদের আবার গুজরাত নিয়ে যেতে এখন মুখিয়ে আছে সে রাজ্যের সরকার। রীতিমতো কর্পোরেট কায়দায় পরমব্রত, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শেখর দাস, সুদেষ্ণা রায়ের মতো পরিচালকদের সামনে গুজরাতি লোকেশনের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছে গুজরাতের টিম ফিল্ম ট্যুরিজম। ‘শিল্পবন্ধু’ রাজ্যের কাছে এই আন্তরিকতা প্রত্যাশিত বলেই মনে করছেন পরম। ‘‘গানের আউটডোর থেকে শুরু করে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক-কাহিনির পটভূমি হিসেবে দারুণ মানাবে গুজরাতকে,’’ বলছিলেন শেখর দাস। কৌশিকবাবু অবশ্য একটু জল মেপে দেখতে চান। গুজরাত যা বলছে, আমলাতান্ত্রিক ফাঁস এড়িয়ে সেটা করে দেখানোটা সহজ নয় বলেই তাঁর মত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy