হাতে আর দু’দিন। জোরকদমে চলছে কার্তিক-লড়াইয়ের মডেল তৈরি। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
পিরামিডের আদলে বাঁশের কাঠামো, তার থাকে থাকে সাজানো নানা মূর্তি, পুতুল। সবচেয়ে উপরে থাকেন কাত্যায়ণী, তার দু’ধারে সখী। কার্তিক-লড়াইয়ে ‘থাকা’ সাজিয়ে পুরাণের নানা গল্প দর্শকের সামনে তুলে ধরাটাই যেন এতদিনের নিয়ম হয়ে গিয়েছিল কাটোয়ায়। গত বছর সেই ধারণাকে ভেঙে দিয়ে ‘থাকা’র আকারে বদল এনেছিল একটি পুজো উদ্যোক্তা। পরিবর্তনের সেই ধারা অব্যহত রেখে ‘থাকা’ সাজানোর নিয়মটাই এ বছর পাল্টে ফেলছে কিছু পুজো উদ্যোক্তা।
পুরনো আমলে কার্তিক-লড়াই কী ভাবে হত, ‘থাকা’য় সেই ছবি তুলে ধরছে কাটোয়ার অন্যতম পুরনো পুজো পশারী পট্টি। বাঁশের কাঠামো আর প্লাইউড দিয়ে তিন ধাপে ‘থাকা’ সাজাচ্ছে তারা। প্রথম ধাপে দেখানো হবে-- পুরাণের গল্প দিয়ে ‘থাকা’ সাজানো হয়েছে, আর সেই ‘থাকা’ বাঁশ দিয়ে বেঁধে কাঁধে চাপিয়ে কার্তিক-লড়াইয়ে নেমেছে বাহকেরা। তারপরেই দেখা যাবে, বাবু সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা সেই ‘থাকা’ আটকানোর চেষ্টা করছে। আর সেই লড়াইয়ের দৃশ্য বাড়ির বারান্দায় বসে উপভোগ করছে আবালবৃদ্ধবনিতা। তার পাশে লড়াইয়ের রাস্তার নানা টুকরো ছবিও তুলে ধরা হয়েছে।
শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেও শোভাযাত্রাগুলি একটি রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত। ফলে সামনাসামনি দেখা হয়ে যেত। সেখানে পরস্পরের শোভাযাত্রা আটকানোটাই যেন রেওয়াজ ছিল। তবে এখন আর সে দিন নেই। শোভাযাত্রা এখন নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে চক্রাকারে যাতায়াত করে। বেহারার বদলে লোহার গাড়িতে ‘থাকা’ বা মূর্তিগুলি সাজিয়ে কার্তিক-লড়াইয়ে যোগ দেয় পুজো উদ্যোক্তারা। পট্টি ভিত্তিক (এলাকা) পুজোর বদলে ক্লাব ভিত্তিক পুজোর প্রচলন হয়েছে। বাবু সম্প্রদায়ও আর নেই। কিন্তু তাঁদের হাতে প্রতিষ্ঠিত কার্তিক-লড়াই ফি বছর আরও জমজমাট হচ্ছে। পশারী পট্টি পুজো কমিটির সদস্য গৌতম দাস বলেন, “কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্যই হল ‘থাকা’। তাই ‘থাকা’র মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে পুরনো আমলে কী ভাবে কার্তিক-লড়াই হতো, তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।”
এ বছরও কাছারি পাড়ার ঝঙ্কার ক্লাব চক্রাকারে ‘থাকা’ সাজিয়েছে। সেখানে কার্তিকের বিভিন্ন ধরণের ২৬টি মূর্তি সাজানো হয়েছে। প্রতিটি মূর্তিকেই শোলার সাজে সাজানো হবে বলেও উদ্যোক্তরা জানিয়েছেন। সুকুমার রায়ের ছড়া ‘ছবি ও গল্প’ অবলম্বনে ‘থাকা’ সাজাচ্ছে প্রতিবাদ ক্লাব। গোয়ালপাড়ার এই ক্লাবটিই বছর দু’য়েক আগে পুরাণের কাহিনি ছেড়ে গুপি গাইন বাঘা বাইন, বিক্রম বেতাল নিয়ে ‘থাকা’য় গল্প সাজিয়েছিল। এ বার সুকুমার রায়ের ওই ছড়ার মধ্যে দিয়ে স্কুলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। ওই ক্লাবের সদস্য শঙ্কর চৌধুরী বলেন, “টিভি দুনিয়া নয়, আমাদের সাহিত্য-জগতেও কার্টুন চরিত্র রয়েছে। সেটাই অভিভাবকদের মনে করিয়ে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য।” ওই পাড়ার বাসিন্দা নিত্যগোপাল গোস্বামীর হাত ধরেই একের পর এক ‘থাকা’র পরিবর্তন এসেছে। তাঁর কথায়, “কার্তিক পুজোকে ঘিরে কাটোয়া শহর দু’ভাগে বিভক্ত। অজয়-ভাগীরথী ধার বরাবর এলাকায় পুজো সংগঠকেরা শোভাযাত্রায় আগ্রহী। আর বাকি কাটোয়া আলো-মণ্ডপে থিম পুজোয় মেতে থাকে।” তাঁর দাবি, “এই পরিস্থিতিতে ‘থাকা’র গুরুত্ব দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত যে কটি ‘থাকা’ টিকে আছে, সেগুলির আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।” তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও ২৪টি ‘থাকা’ হতো, এখন তা দাঁড়িয়েছে ১০টিতে।
গৌরাঙ্গ পাড়ার আওয়াজ ও মণ্ডলপাড়ার প্রতিবন্ধ ক্লাবও চিরাচরিত ‘থাকা’ ছেড়ে নতুন ভাবে ‘থাকা’ গড়ছে। সেখানে নিয়ম মেনে কাত্যায়ণী বা সখীও রাখা হয়নি। তবে পুরাণের গল্প অবলম্বনেই তিনটে থাকে প্যানেল বোর্ড রেখে ‘থাকা’ সাজিয়েছে তারা। আওয়াজের প্রথম থাকে থাকছে তারকাসুর বধ, দ্বিতীয় থাকে অনন্তশয্যায় বিষ্ণু ও তৃতীয়তে নৃসিংহ অবতার। আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তিনটি দৃশ্য তুলে ধরেছে প্রতিবন্ধ ক্লাব। ওই ক্লাবের সদস্য সুজিত ঘোষ বলেন, “দীর্ঘদিন পরে আমরা ‘থাকা’ তৈরি করলাম। পরের বার আমরাও ‘থাকা’র আকর্ষণ বাড়াতে অন্যরকম কিছু করব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy