রোজগার: কুড়িয়ে পাওয়া গুলির খোল। ছবি: পাপন চৌধুরী
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ‘ফায়ারিং স্পট’। পরপর গুলি ছুড়ছেন জওয়ানেরা। খানিক দূরে সার দিয়ে বসে দেখছে জনা দশেক কিশোর। ইনসাস চালানোয় নয়, ওদের গুলিতে আগ্রহ। আরও ভেঙে বললে, গুলির ফাটা খোলে।
পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুরের সিদাবাড়িতে এমন দৃশ্য দেখা যায় ফি সপ্তাহে দিন তিন-চার। সিআইএসএফ জওয়ানেরা অনুশীলন শেষ করে যেতে না যেতেই পলিথিন আর লোহার শিক হাতে কাজে নেমে পড়ে ওই কিশোর-বাহিনী। জমি থেকে খুঁজে বার করে গুলির খোল। মাটি খুঁড়ে বার করে সিসার টুকরো। ওজন দরে তা বিক্রি করে যে ক’টা টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে বই-খাতা, স্কুলের টিফিন কিনবে তারা— দাবি বছর দশ-বারোর নাসিম আনসারি, সাজিদ আনসারিদের।
সিদাবাড়ি থেকে কিলোমিটার দেড়েক দূরে বাথানবাড়ি গ্রামে বাড়ি নাসিমদের। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানায়, মাইথন জলাধারের অদূরে এই গ্রামের আর্থিক ছবিটা বিশেষ ভাল নয়। এলাকায় চাষবাসের সুযোগ তেমন নেই। গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দার উপার্জন বলতে মাইথন বা বরাকর নদীতে নৌকা বাওয়া। প্রশাসনের একাংশের দাবি, ওই এলাকার অনেক বাসিন্দা জড়িত রয়েছেন অবৈধ ভাবে নদীর পাড় থেকে তোলা কোয়ার্ৎজ় পাথর পাচারে।
সিদাবাড়িতে গুলির খোল কুড়োচ্ছে দুই কিশোর। নিজস্ব চিত্র
গ্রাম থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে আল্লাডি ঈশ্বরচন্দ্র মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করে গ্রামের পড়ুয়ারা। সিদাবাড়ি ‘ফায়ারিং স্পট’-এ ঝাড়খণ্ড সিআইএসএফের ওই জওয়ানেরা নিশানা অনুশীলনে এলেই হাজির হয়ে যায় তাদের কয়েকজন। জওয়ানেরা অনুশীলন শেষ করার পরে, লাল ধুলোর মধ্যে পাথরের খাঁজে গুলির খোল খোঁজার ফাঁকে বছর বারোর রোহন আনসারি বলে, ‘‘এগুলো বেচে টাকা পাব। তা দিয়ে খাতা, পেন, স্কুলের টিফিন কিনব। যা বাঁচবে, বাড়িতে দেব।’’
শুধু পড়াশোনার জন্য এই পাহাড় খোঁড়া? খানিক চুপ। পরে মুচকি হেসে রোহনের জবাব, ‘‘একটা ক্রিকেট ব্যাট কিনতে চাই। বাড়িতে বললে দেবে না। সে টাকাটাও জমাচ্ছি একটু একটু করে।’’ তবে সবার তাগিদের কারণ এক নয়। ফাটা খোলের ধারালো কোণায় হাত কেটেছে বেশ কয়েকবার। তা দেখিয়ে নাসিম, সাজিদরা বলে, ‘‘বাড়তি টাকা আসে। তাই খোল খুঁজতে বলে বাড়ি থেকে।’’
ওই কিশোরেরা জানায়, গুলির খোল তারা ৮০ টাকা কেজি দরে গ্রামের ব্যবসায়ী সামসুদ্দিনকে বিক্রি করে। প্রতি বার প্রত্যেকের ২০-২৫ টাকা করে আয় হয়। জিনিসগুলি কোথায় বিক্রি করেন, তা খোলসা করতে চাননি সামসুদ্দিন। শুধু বলেন, ‘‘আগে ভাল দাম মিলত। এখন আর তেমন বাজার নেই।’’ অভিভাবকদের বক্তব্য, সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই ছেলেদের এ কাজে তাঁরা অন্যায় দেখেন না। উল্টে উৎসাহ দেন।
নিশানা-অনুশীলনে আসা এক সিআইএসএফ আধিকারিক জানান, গুলির খোল তাঁদের কাজে লাগে না। তাই ফেলে রেখে যান। গ্রামের ছেলেরা সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে যায়, তা তাঁরা খেয়াল করেছেন। তবে এ বিষয়ে তাঁদের কিছু করার নেই।
ঘটনা জেনে অবাক আল্লাডির শিক্ষাকেন্দ্রটির প্রধান শিক্ষক মানিকচন্দ্র গড়াই। বলেছেন, ‘‘অনেক পড়ুয়াই গরিব পরিবার থেকে আসে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ গুলির খোল কুড়িয়ে পড়ার খরচ জোগাড় করছে, এমনটা শুনিনি। খোঁজ নেব।’’ বিডিও (সালানপুর) তপনকুমার সরকারের আশ্বাস, ‘‘স্কুলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে গরিব পড়ুয়াদের সাহায্যের ব্যবস্থা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy