বিপত্তি: হুহু করে ঢুকছে জল।ছবি: বিকাশ মশান
দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন শীতের শুরুতেই দুর্গাপুর ব্যারাজের উপরে পর্যটকদের ভিড় জমেছে। কাছে গেলেই সেই ধারণা নিমেশেই মুছে যাবে। কারণ, শুক্রবার ভোর ৫টা নাগাদ ডিভিসি ব্যারাজের দুর্গাপুরের দিকের প্রথম লকগেটের একাংশ বেঁকে যাওয়ায় হু হু করে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। তা দেখতে ভিড় জমে গিয়েছে ওই এলাকায়। যেমনটা দেখা গিয়েছিল বর্ষায় দুর্গাপুর ব্যারাজে জল ছাড়ার সময়। তবে বর্ষার আনন্দের সঙ্গেই এ দিন মিশেছিল শীতের বিষণ্ণতাও!
বর্ষায় ব্যারাজে ঝালমুড়ি, চপ-বেগুনি নিয়ে বসে পড়েন অনেকেই। চায়ের দোকান, পানগুমটি খোলা থাকে দীর্ঘক্ষণ। শুক্রবার ব্যারাজে গিয়েও দেখা গেল একই ছবি। ভিড় আটকাতে ফিডার ক্যানালের সেতুর উপর দিয়ে ব্যারাজে ওঠার রাস্তা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পুলিশ। গাড়ি দূরে রেখে বাঁশ টপকে পুলিশ কর্মীর চোখ এড়িয়ে অনেকেই পৌঁছে গিয়েছেন ব্যারাজের উপরে। এই সুযোগে ঝালমুড়ি, চপ-বেগুনি নিয়ে বসে গিয়েছেন কেউ কেউ। চা, পানের দোকান খোলা সারাদিন। রাতুরিয়া, পলাশতলা, তেঁতুলতলা কলোনি, ডিপিএল কলোনি, ডিসিএল কলোনি, আশিস নগর, শ্যামপুর-সহ নানা এলাকা থেকে লোকেরা ভিড় জমিয়েছেন ব্যারাজে।
কেন এই অকাল ভিড় ব্যারাজে? শুক্রবার ভোর থেকে ব্যারাজের ১ নম্বর গেটটি বেঁকে গিয়ে জল বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে হুড় হুড় করে। তা দেখতেই এই ভিড়। কিন্তু একই সঙ্গে অনেকেরই চোখে-মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপও নজরে এসেছে। তেঁতুলতলা কলোনির দীপক বারিক বলেন, ‘‘দুর্গাপুরের পানীয় জল থেকে শিল্প-কারখানার জল, সব যায় ব্যারাজ থেকেই। জলস্তর নামতে শুরু করেছে। পানীয় জলের জন্য চিন্তায় পড়ে গিয়েছি।’’ অঙ্গদপুর এলাকার সোমা দত্ত বলেন, ‘‘বর্ষার মতোই বেশ উৎসবের আমেজ ব্যারাজে। তবে যত দ্রুত মেরামতি হয় ততই মঙ্গল। তা না হলে পানীয় জল নিয়ে সমস্যায় পড়ে যাব।’’
জল দেখতে উৎসুক মানুষের উঁকিঝুঁকি।
দুর্গাপুরে ব্যারাজ গড়ে উঠেছিল ১৯৫৫ সালে। শুরুতে ব্যারাজের জলধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। পলি সংস্কার না হওয়ায় এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেচ দফতহর সূত্রে খবর, দামোদরের উপরে লম্বায় ৬৯২ মিটার এই ব্যারাজে গেটের সংখ্যা ৩৪টি। দুর্গাপুরের দিকের প্রথম ১ নম্বর গেটটি পুরো নামানো হয়নি। গেট ও নীচের মেঝের মাঝে প্রায় ফুট দেড়েক ফাঁক রয়েছে। গেটের একদিক বেঁকেও গিয়েছে। ফলে গড়ে ঘণ্টায় ৪ ইঞ্চি হারে জলস্তর নেমে যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। কারণ, এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ প্রথমে একটি ক্রেন এনে মেরামতি শুরু করার চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। গেটটিকে জল থেকে বেশ কিছুটা উপরে তুলে সেটিকে সোজা করে, ঝালাই দিয়ে বেঁকে যাওয়া অংশের মেরামতি করার পরিকল্পনা করে সেচ দফতর। কিন্তু জলের চাপে ক্রেন দিয়ে গেটটি তোলা সম্ভব হবে না বুঝে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
ব্যারাজ থেকে দামোদরের জল কিনে পরিশোধন করে পানীয় জল হিসাবে তা শহরে সরবরাহ করে এডিডিএ, পুরসভা, ডিএসপি, ডিপিএল, ডিটিপিএস-সহ নানা সংস্থা। দুর্গাপুরের একাধিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, অন্যান্য শিল্প কারখানাতেও জলের জোগান দেয় দামোদরই। ডিএসপি সূত্রে জানানো হয়েছে, ক্যানালে জলস্তর নেমে যাওয়ায় পাম্প হাউসে জল আসার পরিমাণ কমেছে। সে জন্য জল সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুর্গাপুরের মহকুমা শাসক শঙ্খ সাঁতরা বলেন, ‘‘এ বার ভাল বৃষ্টি হয়েছে। তাই জলাধারে অন্য বারের থেকে বেশি জল রয়েছে। তাই জলস্তর সামান্য নেমে গেলে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে দীর্ঘক্ষণ জল বেরিয়ে গেলে সমস্যা হবে। তা যাতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এনে মেরামতির কাজ শুরু করেছে সেচ দফতর।’’
জলের চাপ না কমলে কোনও ভাবেই মেরামতির কাজ করা সম্ভব নয়, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন। এরপরেই ডিভিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপরে মাইথন জলাধার থেকে জল ছাড়া বন্ধ করার আর্জি জানানো হয়। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ মাইথন থেকে জল ছাড়া বন্ধ করে দেন। গেটের সামনে বালির বস্তা ফেলে জলের স্রোত কমানোর চেষ্টা শুরু হয়।
তবে প্রশ্ন উঠেছে এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে? প্রশাসন সূত্রে খবর, জলাধারের গেটগুলি রক্ষাবেক্ষণের জন্য বছরে ১০-১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য। কিছুদিন রং করা হয়েছে। তার পরেও এমন ঘটনার জন্য প্রশাসনিক কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক শঙ্খ সাঁতরা বলেন, ‘‘সেচ দফতরের মুখ্য বাস্তুকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই।’’
এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাঁকুড়ার দিকেও। এ ব্যপারে বড়জোড়ার বিডিও পঙ্কজকুমার আচার্যও বলেন, ‘‘আশঙ্কার এখনই কোনও কারণ নেই। ওই লকগেট দিয়ে ৫ হাজার কিউসের হারে আশেপাশে জল বের হচ্ছে। যেটা সমস্যা তৈরি করবে বলে মনে করছি না।’’ সেই সঙ্গে তিনি জানান, বড়জোড়া ও সোনামুখীর মানাচর গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে বলা হয়েছে।
রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দেন, ‘‘চিন্তার কোনও কারণ নেই। দ্রুত মেরামতির জন্য যা যা করা দরকার, তা করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy