Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

বর্ধমানে কার্জন গেটের মতো তোরণ গ়়ড়ার সিদ্ধান্তে বিতর্ক

ঐতিহাসিক কার্জন গেটের মতোই আরও একটি স্মারক তোরণ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা পরিষদ। শহরের কাছারি রোডের উপর প্রশাসনিক ভবন, আদালত চত্বরের কাছাকাছি ওই গেট তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু। তাঁর দাবি, ব্রিটিশদের সম্মানে কার্জন গেট গড়েছিলেন বর্ধমানের রাজা।

কার্জন গেটের মতো আরও একটি তোরণ গড়া নিয়ে বিতর্ক। —নিজস্ব চিত্র।

কার্জন গেটের মতো আরও একটি তোরণ গড়া নিয়ে বিতর্ক। —নিজস্ব চিত্র।

উদিত সিংহ
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

ঐতিহাসিক কার্জন গেটের মতোই আরও একটি স্মারক তোরণ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা পরিষদ। শহরের কাছারি রোডের উপর প্রশাসনিক ভবন, আদালত চত্বরের কাছাকাছি ওই গেট তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু। তাঁর দাবি, ব্রিটিশদের সম্মানে কার্জন গেট গড়েছিলেন বর্ধমানের রাজা। এই নতুন তোরণে জেলার মনীষীদের ছবি বসিয়ে তাঁদের সম্মান জানানো হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে জেলার সাহিত্যিক-ইতিহাসবিদদের মধ্যে। অনেকের মতেই, আত্মপ্রচারের উদ্দেশে ইতিহাসকে খাটো করা ঠিক নয়।

জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, গেটটির জন্য প্রাথমিক ভাবে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজস্থান, বেঙ্গালুরু-সহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে মার্বেল শিল্পীদের এনে জেলার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের ছবি ফুটিয়ে তোলা হবে বলেও জানা গিয়েছে। প্রশাসনের দাবি, কার্জন গেটের মতো এই গেটের নীচ দিয়ে যাওয়ার সময়েও নজরুল ইসলাম, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, ঘনরাম চক্রবর্তীদের মতো মনীষীদের ছবি দেখে লোকে সম্মান জানাবেন, ইতিহাসকে মনে করবেন। দেবু টুডুর কথায়, ‘‘কার্জন গেটের গুরুত্ব রয়েছে, এই তোরণের নামে বর্ধমান পরিচিতও। কিন্তু ব্রিটিশদের জন্য বর্ধমানের রাজারা ওই গেটটি তৈরি করিয়েছিলেন। এখন আমরা নতুন গেট গড়ে জেলার বিখ্যাত মনীষীদের ছবি বসাব। তাতে তাঁদের সম্মান জানানো হবে, আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্মারক হয়েও থাকবে।’’ যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনও প্রশাসনিক মহলে কোনও আলোচনা হয়নি। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) হৃষিকেশ মোদী বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি। সভাধিপতি নিজেই ব্যাপারটি দেখছেন।’’ জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইলেরও দাবি, ‘‘সভাধিপতি এখনও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেননি। পরে বৈঠক ডাকবেন বলে আশা করছি।’’

তবে নতুন তোরণ নির্মাণের কথায় আলোড়ন উঠেছে লেখক, ইতিহাসবিদ মহলে। বর্ধমানের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ নীরদবরণ সরকার যেমন সাফ বলেন, ‘‘কার্জন গেটের সমতুল নতুন তোরণ তৈরির পরিকল্পনা সমর্থনযোগ্য নয়। এ শহরে রাজাদের অনেক স্থাপত্যকীর্তি রয়েছে, তাহলে তো অনেক কিছুকেই বাতিল করে দিতে হয়।’’ তিনি জানান, লর্ড কার্জনের আগমন উপলক্ষ্যে ১৯০৪ সালে এই গেটটি নির্মিত হয়েছিল। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বই আলাদা। তাছাড়া বর্ধমানে অনেক মনীষীর জন্মেছেন। তাঁদের সবার ছবি ওই তোরণে স্থান দেওয়া যাবে কি না, সে প্রশ্নও তোলেন নীরদবাবু। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ রত্না রশিদও বলেন, ‘‘নতুন তোরণ কী উদ্দেশ্যে হচ্ছে তা জানতে হবে। আত্মপ্রচারের জন্য কেউ যদি ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করতে চান, তার দরকার আছে বলে মনে করি না। তাছাড়া এখন তো আর কার্জন গেট নয়, রাজা বিজয় চন্দের তৈরি বলে আমরা সেটিকে বিজয় তোরণ নামে ডাকি।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘বর্ধমানের রাজ ইতিহাসের একটা অঙ্গ হল বিজয়তোরণ। তাই পাল্টা গেট তৈরি করে রাজ ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা হলে তা সমর্থন করি না।’’

উদ্যোগকে ভাল চোখে দেখছে না বিরোধীরাও। জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি উদয় সরকার বলেন, ‘‘তোরণ নির্মাণের চেষ্টা অপব্যয় ছাড়া কিছুই নয়। এত বাহ্যিক আড়ম্বরে না গিয়ে জেলার মনীষীদের অন্য ভাবেও সম্মান জানানো যায়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘ এই সরকার মেলা-উৎসবের সরকার। জেলায় আলু-ধান চাষিরা আত্মঘাতী হচ্ছেন। দাম পাচ্ছেন না। সেখানে গরিব মানুষের জেলার প্রতিনিধিদের এ সব মানায় না।’’

তবে অনেকেই আবার এই উদ্যোগকে প্রশংসার চোখে দেখছেন। বর্ধমান হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশন এবং বর্ধমান ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক সর্বজিৎ যশ যেমন বলেন ‘‘জেলার মনীষীদের সম্মান জানানোর এটা ভাল উদ্যোগ। হারিয়ে যাওয়া মনীষীদের খুঁজে এখানে স্থান দিতে পারলে ভাল হয়।’’ শহরের তৃণমূল নেতাদের মতেও, ইতিহাসকে বিকৃত করা বা পাল্টা তোরণ তৈরি করা হচ্ছে ভাবলে ভুল হবে, বরং নতুন স্মারক গড়ে মনীষীদের সম্মান জানানোর একটা চেষ্টা করা হচ্ছে এ ভাবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE