স্কুলে তখন প্রার্থনা চলছিল। তখনই খবর আসে, আদালতের রায়ে সাত জন শিক্ষিকা এবং এক জন শিক্ষকের চাকরি যাচ্ছে। দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি হাই স্কুলের স্টাফ রুমে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁদের কেউ কেউ। বাকিরা তাঁদের সান্ত্বনা দিতে থাকেন। এক শিক্ষিকা বলেন, ‘‘নিয়ম মেনে পরীক্ষা দিয়েছি, কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আমার কী গাফিলতি?’’ শিক্ষিকা রুমা মাশান বলেন, ‘‘স্কুলে এসে খবরটা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। আশা ছিল, যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করে চূড়ান্ত রায় আসবে। সহকর্মীদের এ ভাবে বিপদে পড়তে দেখে আমরাও অসহায় বোধ করছি।’’
একই রকম ভাবে এ দিন অসহায় বোধ করেছেন জেলার অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা। জেলা স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আদালতের রায়ে জেলার ৩৪৭ জন চাকরি হারালেন। দুর্গাপুরের জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যাপীঠের তেমন এক শিক্ষিকা জানান, ২০১১ সালে প্রথম বার স্নাতক স্তরে এসএসএসি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পান। ইন্দাসে, আসানসোলের স্কুলে চাকরি করেছেন। ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়ে যোগ দেন জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যাপীঠে। তিনি বলেন, ‘‘যোগ্য হয়েও শুধু ২০১৬ সালের প্যানেলে নিযুক্ত বলে এই পরিণতি হল আমার!’’
বর্তমানে কাঁকসার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আগে পূর্ব বর্ধমানের এক প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করতেন। তিনি জানান, ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। ২০১৯ সালে কাঁকসার স্কুলে যোগ দেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ওই শিক্ষকের কথায়, ‘‘সব কিছু নিয়ম মেনে করেও আমাদের চাকরি গেল। আমরা শিক্ষক। এ ভাবে চাকরি যাওয়ায় সমাজে মানসম্মান খোয়াতে হল। যে ভাবে যোগ্য ও অযোগ্যদের এক করে দেওয়া হল, তাতে সমাজে খুব ভাল বার্তা যাবে না।’’ তাঁর দাবি, এসএসসি বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ঠিক তথ্য দিলে সবার চাকরি হয়তো যেত না। কাঁকসার একটি স্কুলের এক শিক্ষিকাও অন্যত্র এক স্কুলে চাকরি করতেন। কিন্তু বাড়ির কাছে থাকার জন্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে এখানে যোগ দেন। তিনিও চাকরি হারিয়েছেন। তাঁরও দাবি, ‘‘নিজের যোগ্যতায় চাকরি করতাম। আগের স্কুলে থাকলে হয়তো এই দিনটা দেখতে হত না। প্রতিবেশীদের অনেকেই হয়তো এখন ভাবছেন, আমরা অযোগ্যই।’’
‘যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের’ (গ্রুপ সি ও ডি) সদস্য সৌম্যব্রত সাহা বলেন, ‘‘এই রায়ে আমরা খুব হতাশ। এক দিকে বলা হয়েছে, যাঁরা অযোগ্য তাঁদের সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে, তাহলে নিশ্চয় অযোগ্যদের কোনও নির্দিষ্ট তালিকা ছিল। তাহলে যোগ্যদের চাকরি কেন গেল? কেউই এর দায় এড়াতে পারেন না।’’ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ দাবি করেন, ‘‘আদালত পরিষ্কার জানিয়েছে, রাজ্য সরকার যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথক করতে পারেনি বলেই এই রায়। রাজ্য সরকার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।’’ ‘অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ’ সংগঠনের সদস্য চিরঞ্জিত ধীবরের দাবি, ‘‘প্রথম অভিযোগ ওঠার পরেই সরকারের উচিত ছিল অযোগ্যদের পৃথক করে স্বচ্ছতা প্রমাণ করা। তা না করায় আদতে যোগ্য শিক্ষকেরা অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হলেন। রাজ্য সরকারকে যোগ্যদের চাকরির ব্যবস্থা করতেই হবে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)