শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল নিয়ে বিক্ষোভ-বিতর্কের ঘূর্ণিঝড় উঠেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’-র নিন্দুকের সেই প্রশ্নটি— ‘মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?’ চাকরি-হারা শিক্ষকদের ক্ষোভ টিভি ক্যামেরায় আছড়ে পড়ছে, বিরোধী নেতাদের গলা চড়েছে তার-সপ্তকে। কিন্তু সরকারের অনিয়ম, নেতাদের উৎকোচ-লোলুপতা, প্রশাসকদের বিবেকহীনতা, এ সব কিছুর আঘাত যেখানে সর্বাধিক ক্ষত তৈরি করল, সেই সরকারি স্কুলগুলি রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। সেই ক্ষতি ঠিক কতখানি— প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক কর্মচ্যুত হওয়ার পরে স্কুলগুলিতে শূন্য পদের সংখ্যা কোথায় কেমন হবে— তার তথ্যও সরকার পেশ করতে অনিচ্ছুক, অপারগ। বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো, ছোট ছোট ছবি থেকে তার আন্দাজ করতে হয়। সংবাদে যেমন এসেছে ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল ব্লকের একটি গ্রামীণ স্কুলের কথা। জুনিয়র হাই স্কুলের একমাত্র স্থায়ী শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন, দু’জন অতিথি শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। অতএব পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি অবধি চারটি ক্লাস শিক্ষকশূন্য। অগত্যা এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এগিয়ে এসেছেন, পরীক্ষার তদারকিতে। চল্লিশ জন ছাত্রছাত্রীর ওই স্কুলটি শিক্ষকহীন হয়ে পড়ল। কতগুলি স্কুলের এমন দশা হল, সে তথ্য কি কখনও জানা যাবে? ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের গোড়ায় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বিধানসভায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে, রাজ্যে স্কুলগুলিতে শূন্য শিক্ষক পদের সংখ্যা ৭৮১। ওই একই সময়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে ৫৩,১৩৭ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৭৩৭৮ শূন্য পদ ছিল। কেন এই বিপুল ব্যবধান? শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের সহায়িকা কিংবা স্কুলের পার্শ্বশিক্ষককে রাজ্য ‘শিক্ষক’ বলে ধরছে, কেন্দ্র ধরছে না, সে জন্যই কি? তথ্যের অধিকার আইনে প্রশ্ন করেও মিলেছে শুধু ধোঁয়াশা।
থার্মোমিটার যখন নেই, তখন কপালে হাত দিয়ে জ্বরের আন্দাজ করাই উপায়। এ রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বা শহরের দরিদ্র অঞ্চলের স্কুলগুলির সংস্পর্শে আসামাত্র বোঝা যায়, এগুলি স্কুলের খোলসমাত্র। প্রাথমিক স্কুলগুলিতে প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণি চালু হয়েছে, ক্রমশ যোগ হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণিও। অথচ, কোথাও প্রাক্-প্রাথমিকের শিক্ষক নেওয়া হয়নি, বহু স্কুলে যথেষ্ট ক্লাসঘরও নেই। উচ্চ-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলির সমস্যা প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষকের অভাব। বিশেষত বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ক্লাসগুলিতে পঠনপাঠন প্রায় অচল হয়ে গিয়েছে বহু স্কুলে। শিক্ষকের অভাবকে নানা স্কুল নানা ভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কোথাও অভিভাবকদের অনুদান নিয়ে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে, কোথাও এক দিন একাদশ শ্রেণি, এক দিন দ্বাদশ শ্রেণি পালা করে স্কুলে আসছে। করুণ কৌতুক এই যে, এ বছর থেকেই শুরু হয়েছে ‘সার্বিক প্রগতি মূল্যায়ন’ (হোলিস্টিক প্রোগ্রেস রিপোর্ট) যা সতেরোটি দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মূল্যায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ পঠনপাঠন ও মূল্যায়ন যখন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের আরও বেশি মনোযোগ ও পর্যবেক্ষণ দাবি করছে, আরও নিবিড় সংযোগকে শর্ত করছে, ততই কমছে শিক্ষকের সংখ্যা। অর্থাৎ শিক্ষণ-ব্যবস্থা চলেছে এক দিকে, আর এক দিকে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো।
তবে নিয়োগ-কেলেঙ্কারির অভিঘাত কেবল স্কুলে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের শূন্য পদের বৃদ্ধি দিয়েই মাপলে চলবে না। অভাবের চাইতেও বড় হয়ে উঠেছে অনাস্থা। শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা বিচার করেন। আজ ছাত্রছাত্রীদের মনে সংশয় ঢুকেছে, আমার শিক্ষক কি যোগ্য? শিক্ষকের নৈতিক অবস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, এ সব কিছু প্রশ্ন উঠে গেল শিক্ষার্থীর মনে। যদি বা কখনও সব শিক্ষকের পদ পূরণ হয়, আস্থায় এই ঘাটতি পূর্ণ হওয়ার নয়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)