লোকসভায় বক্তৃতা করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া।
অষ্টাদশতম লোকসভার বাজেট অধিবেশনে তাঁর প্রথম বক্তৃতার সময়েই সরকার পক্ষের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি এতটাই দূর পর্যন্ত যায় যে, বক্তৃতা থামিয়ে অভিষেক বলে বসেন, সরকার পক্ষের সাংসদেরা ক্ষমা না-চাওয়া পর্যন্ত তিনি বক্তৃতা শুরু করবেন না। স্পিকার অবশ্য তাঁকে সে জন্য মৃদু সতর্কীকরণও শোনান। পরে উভয় পক্ষের বক্তব্যই সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ায় আবার বক্তৃতা শুরু করেন অভিষেক।
ঘটনার সূত্রপাত অভিষেক বক্তৃতা শুরু করার বেশ কিছু ক্ষণ পরে। প্রথম থেকেই মোদী সরকারের বাজেট নিয়ে আক্রমণাত্মক ছিলেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। নথিপত্র নিয়ে তৈরি হয়েই তিনি এসেছিলেন লোকসভায়। সেই নথি থেকে তথ্য তুলে ধরে ধরে অভিষেক আক্রমণ করতে থাকেন ২৪ ঘণ্টা আগে পেশ-করা নির্মলা সীতারামনের বাজেটকে। কেন্দ্রীয় বাজেটে ‘বৈষম্য’ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।
অভিষেক বক্তৃতা করার সময় অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন দিলীপ শইকিয়া। তৃণমূল সাংসদ অভিযোগ করেন, মোদী সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে বঞ্চনা করেছে। সেই প্রসঙ্গে অভিষেক টেনে আনেন এক সাংসদের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘এই সংসদের এক সদস্য যেমন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহার করেছেন!’’ ওই বক্তব্য নিয়ে অধ্যক্ষের আসন থেকে প্রথমেই আপত্তি জানান দিলীপ। তিনি বলেন, ‘‘যিনি এই সংসদের সদস্য নন (সংশ্লিষ্ট সাংসদের স্ত্রী), তাঁকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না।’’ তার পরেই বিজেপি সাংসদেরা আপত্তি জানাতে শুরু করেন। বিজেপি সাংসদেরা কিছু ‘কুরুচিকর’ মন্তব্য করেন বলেও অভিযোগ। পরে তৃণমূলের সাংসদেরা জানান, সরকার পক্ষ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছিল। লোকসভার ভিতরে মমতা সম্পর্কে ওই মন্তব্য আসার পরেই পাল্টা রে-রে করে ওঠেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্র, সায়নী ঘোষেরা। দু’পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে অধ্যক্ষের আসনে ফিরে আসেন ওম বিড়লা। দু’পক্ষকে তিনি থামানোর চেষ্টা করলে অভিষেক বলেন, অধ্যক্ষ সরকার পক্ষের সাংসদদের ক্ষমা চাইতে বলুন! নচেৎ তিনি বক্তৃতা শুরু করবেন না। অধ্যক্ষ তৃণমূল সাংসদকে বলেন, তিনি অধ্যক্ষকে নির্দেশ দিতে পারেন না! তবে তিনি সরকার পক্ষের ওই ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, অভিষেকের আগের বক্তব্য আগেই দিলীপ শইকিয়ার হস্তক্ষেপে সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ গিয়েছিল।
বাকি সময়টা অভিষেক মোদী সরকারের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা আক্রমণ করেন। প্রথমেই তিনি বলেন, ‘‘আমি সেই ভাষাতেই কথা বলব, যা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বোঝেন।’’ বাজেটের ইংরেজি বানানকে ভেঙে মোদীকে আক্রমণ করেন অভিষেক। ইংরেজি ‘বাজেট’ শব্দটিকে ভেঙে ভেঙে অভিষেক বলেন, ‘‘বি মানে বিট্রে (বিশ্বাসঘাতকতা), ইউ মানে আনএমপ্লয়মেন্ট (বেকারত্ব), ডি মানে ডিপ্রাইভ (বঞ্চনা), জি মানে (গ্যারান্টি), ই মানে একসেনট্রিক (উদ্ভট) এবং টি মানে ট্র্যাজেডি (দুঃখজনক)।’’ প্রতিটি ক্ষেত্রে উদাহরণও দেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘মোদী সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি ‘অচ্ছে দিনে’র কথা বলেছিল। কিন্তু কিছুই ভাল হয়নি।’’ ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের কথায় উঠে এসেছে মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গও। পাশাপাশিই তিনি মোদীকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘‘শরিকদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে মোদী সরকারকে। শরিকদের সন্তুষ্ট করতে এই বাজেট তৈরি করা হয়েছে।’’
ঘটনাচক্রে, অভিষেক মঙ্গলবারেই বাজেট পেশের পরে তার কড়া নিন্দা করেছিলেন সংসদ চত্বরে দাঁড়িয়ে। বুধবার লোকসভায় ঠিক সেখান থেকেই তিনি তাঁর আক্রমণ শুরু করেন। মঙ্গলবারের মতোই শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে অভিষেক মোদী সরকারকে আক্রমণ করেন। বলেন, এই বাজেট শুভেন্দুর ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশের বদলে যো হমারে সাথ, হম উনকে সাথ’ বক্তব্যকেই প্রমাণ করেছে।
বাংলার প্রতি কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’র কথাও বলেছেন রাজ্যের শাসকদলের অন্যতম শীর্ষনেতা। তাঁর কথায়, ‘‘২০২১ সালে বাংলায় বিজেপি ধরাশায়ী হওয়ার পর থেকে কেন্দ্র কোনও প্রকল্পে একটা টাকাও দেয়নি।’’ আবাস যোজনা, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন ইত্যাদি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের উদাহরণ দেন অভিষেক। জিএসটি, নোটবন্দির কথাও বলেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে অভিষেক বলেন, ‘‘বাংলাকে ক'টাকা দেওয়া হয়েছে, তা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বলুন।’’ তৃণমূলের সেনাপতির কথায়, ‘‘কালো টাকা ফিরবে বলে দাবি করে নোটবন্দি চালু করেছিল মোদী সরকার। কিন্তু আদৌ তা বাস্তবায়িত হয়নি।’’ ২০১৬ সালের কলকাতার পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনার উল্লেখ করে অভিষেক বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কলকাতার একটি সেতু ভেঙে পড়া নিয়ে বলেছিলেন, ‘অ্যাক্ট অফ গড নয়, অ্যাক্ট অফ ফ্রড’। কিন্তু গুজরাতের মোরাবি সেতু বিপর্যয়, একাধিক রেল দুর্ঘটনাতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেগুলোকে কী বলবেন মোদী?’’ মনে করিয়ে দেন, ‘‘এ বারের বাজেটে রেলের সুরক্ষা, কবচ এ সব বিষয় নিয়ে কোনও কথার উল্লেখ নেই।’’
লোকসভায় ভাষণের শেষের দিকে অভিষেকের মুখে শোনা যায় শাহরুখ খানের ছবি ‘পাঠান’-এর সংলাপও। তিনি বলেন, ‘কুর্সি কি পেটি বান্ধ লিজিয়ে, মওসম বিগারনেওয়ালা হ্যায়!’ যার বাংলা তর্জমা করলে হয়, ‘আবহাওয়া খারাপ হতে চলেছে। নিজের সিট-বেল্ট ভাল করে বেঁধে নিন।’ পরে অভিষেকের বক্তব্যের এই অংশ এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্টও করেছে তৃণমূল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy