টিভি সারিয়ে এনে দোকানেই রাখলেন শিবেদা।
সর্বমঙ্গলা দলের কর্তা কালীগতি দত্ত তাঁদের জেতা শিল্ড তুলে দিয়েছিলেন হেরে যাওয়া হাড়ভাঙা গ্রামের জমিদার গোবর্ধন চৌধুরীর হাতে। কিন্তু তার পরেও ‘ধন্যি মেয়ে’র ওই দুই ফুটবলপ্রেমীর মধ্যে মিল হয়েছিল কি না, তা কারও জানা নেই।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনা-পাগল শিবেদা আর ‘ধন্যি মেয়ে’র অভিনেতা তথা ব্রাজিল-ভক্ত অশোক কর অবশ্য এক হয়েছেন। হাজারো ইষ্টনাম জপেও নিজেদের দলকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি ইছাপুর নবাবগঞ্জের শিবশঙ্কর পাত্র ও হাওড়ার হালদার পাড়ার অশোকবাবু। তবে রবিবার তাঁরা এককাট্টা হয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার জন্য। আর মনে-প্রাণে চেয়েছেন, কাপ নিয়ে যাক ওই ছোট দেশটি। ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন করলেও অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পরে এই সমর্থনটাও জলেই গেল ওঁদের।
ঘরের খারাপ হওয়া পুরনো মডেলের টিভিটা অবশেষে সারিয়ে এনেছেন শিবেদা। রবিবার দুপুরে আর্জেন্টিনার রঙে রাঙানো বাড়ির একতলায় নিজের দোকানে টিভি কোথায় বসাবেন, তা নিয়েই চিন্তায় পড়েছিলেন বছর পঞ্চাশের ওই মেসি-ভক্ত। বললেন, ‘‘এমন ভাবে রাখতে হবে যাতে খদ্দের, বাড়ির লোক সকলে দেখতে পান।’’ তবে তিনি কিংবা তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাদেবী, মেয়ে নেহাই শুধু নয়। কাট আউটের মেসিকে পাশে বসিয়েই খেলা দেখবেন তাঁরা।
৮০ বছরের ‘যুবক’ অশোকবাবু অবশ্য তেমনটা করেননি। সকাল থেকেই পুরনো ভাল খেলাগুলি আর এক বার করে দেখে স্মৃতিটা ঝালিয়ে নিয়েছেন। কখনও আবার টিভির স্টপার, ফরোয়ার্ডদের দেখে নিজের স্মৃতি উসকে বল নিয়ে ঘরের মধ্যেই নাড়াচাড়া করেছেন। তবে ব্রাজিল
এ দিন রাশিয়ায় ফাইনালের মাঠে থাকলে সারা বাড়িটা হলুদ-সবুজে রাঙিয়ে তুলতেন বলেই দাবি কালীগতি দত্ত ওরফে উত্তমকুমারের সঙ্গে এক ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মালিক অশোকবাবুর। বললেন, ‘‘আফসোস তো একটা রয়েছে। ব্রাজিলের আরও লড়াকু হওয়া দরকার ছিল। তবে ক্রোয়েশিয়া খুবই লড়াকু মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে।’’
আর্জেন্টিনার মধ্যে সমঝোতার অভাবের আক্ষেপ এখনও পিছু ছাড়ছে না শিবেদাকে। তবে ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে সেই সমঝোতা রয়েছে বলেই তাদের সমর্থন করলেন, জানালেন ওই মেসি-ভক্ত। বললেন, ‘‘নিজেদের মধ্যে কত সুন্দর বোঝাপড়া। শেষ তিনটে খেলায় ২৫ মিনিটের পর থেকে কী লড়াইটাই না লড়ল!’’ স্বামীর সঙ্গে খেলা দেখবেন বলে সকালেই রাতের রান্না সেরে রেখেছেন স্বপ্নাদেবী।
ফাইনাল ম্যাচের আগে ইংল্যান্ড ও বেলজিয়ামের মধ্যে তৃতীয় স্থান নির্ধারক খেলাটি ফের দেখছেন অশোকবাবু। রবিবার।
গোবর্ধনের কথায় সায় দিয়ে হাড়ভাঙা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ঠাকুরদা বলেছিলেন, ‘জোর যার মুলুক তার!’ গাঁয়ের পুরুত তোতলা ভট্টাচার্যও তাতে তাল মিলিয়েছিলেন। তেমনিই অশোকবাবু, শিবেদার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন লেক টাউনের মন্দিরা দেবনাথ। বেসরকারি সংস্থার কর্মী, ব্রাজিলের ভক্ত ওই তরুণী কয়েক দিন আগেই সাম্বার সাজে ঘুরে বেরিয়েছেন গোটা শহর।
ব্রাজিলের বিদায়ের পরে মন্দিরা ভেবেছিলেন, আর খেলাই দেখবেন না। তিনি বলেন, ‘‘ক্রোয়েশিয়া কিন্তু বড্ড ভাল খেলল। কী মনের জোর, ভাবা যায় না।’’ হলুদ-সবুজ পতাকাগুলি এখন সাজানো রয়েছে মন্দিরার বাড়ির ড্রয়িং রুমে। তার মধ্যেই এ দিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে লাল-সাদা বেলুন।
কম যান না অশোকবাবুর ছেলে অরুণাভও। ব্রাজিল-ভক্ত ওই যুবক কোয়ার্টার ফাইনালের সময়েই পাড়ি দিয়েছেন রাশিয়ায়। আশা ছিল, প্রিয় দল কাপ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছবিটা স্বচক্ষে দেখে আসবেন। রবিবার রাশিয়ার স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে অরুণাভ বললেন, ‘‘ব্রাজিলের হারের পরে মুষড়ে পড়লেও চাঙ্গা হয়েছি ক্রোয়েশিয়ার খেলা দেখে। আজ বিশ্বকাপের দশমী হলেও ক্রোয়েশিয়া ভক্তদের কাছে যেন বোধন।’’
বিশ্বকাপের বাজারে শিবেদা থেকে অশোকবাবু, সকলেই হারলেন আর এক বার। আর শেষ হাসি হাসলেন ফরাসিরাই।
ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায় ও নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy