‘ভাই’। টিটাগড়ের চালু লব্জ। রাজ নিখোঁজ হওয়ার পরে তোলাবাজির পাশাপাশি প্রায় প্রকাশ্যেই গাঁজার কারবার শুরু করে দেয় রাজু। তখন থেকেই সকলে ‘ভাই’ বলে ডাকতে শুরু করে তাকে।
কিন্তু শাগরেদদের রাজু জানিয়ে দেয়, ভাই ডাক তার না-পসন্দ। লোকে তাকে দাদ্দা নামে চিনুক, এটাই সে চায়। দাদ্দা নাকি তার ডাকনাম। তার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় রাজুকে দাদ্দা বলে ডাকা। রাজুর প্রাক্তন এক শাগরেদ জানায়, দাদ্দা তোলাবাজি ছেড়ে মাদকের কারবারের পাশাপাশি খুনের জন্য সুপারি নেওয়াও শুরু করে। তার জন্য দাদ্দা নিজে বিহারে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে আনে। তার এক সময়ের পড়শি এক ব্যক্তি জানান, রাজুর দুই শাগরেদ কোমরে ওয়ান-শটার গুঁজে রাস্তায় ঘুরত। এক দিন তা চোখে পড়ে যায় দাদ্দার। প্রকাশ্যেই দু’জনকে ভর্ৎসনা করে দাদ্দা। সে বলে, আবার এমন করলে দল থেকে বার করে দেওয়া হবে তাদের।
রাজুর ওই পড়শি জানান, দাদ্দা বেশি প্রচার বা দেখনদারি পছন্দ করে না। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কাজ করতেই পছন্দ করে সে। সেই কারণে দাদ্দার নাম শুনলেও তাকে কেমন দেখতে, তা জানেন না টিটাগড়ের বেশির ভাগ বাসিন্দাই।
তবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেশি দিন আড়ালে থাকা সম্ভব হয়নি দাদ্দার। এক সময়ে শিল্পাঞ্চলে মাদকের রমরমা এমন বেড়ে যায় যে, পুলিশ ব্যাপক ধরপাক়ড় শুরু করে। জানা যায় দাদ্দার নাম। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে খদ্দের সেজে তাকে ধরে পুলিশ। বছরখানেক জেলে কাটিয়ে এলাকায় ফিরে গাঁজার পাশাপাশি মাদকের কারবারও শুরু করে দাদ্দা। তাতে নামায় নিজের ভাই এবং ঘনিষ্ঠ কয়েক জন আত্মীয়কে। যাদের বেশ কয়েক জন মহিলা। বাইরে থেকে আসা মাদকের হাতবদল হত শহরতলির বিভিন্ন রেল স্টেশনে। মূলত মহিলারাই এক শহর থেকে অন্য শহরে মাদক পাচার করত। ধীরে ধীরে মফস্সল ছাড়িয়ে উত্তর কলকাতাতেও মাদক পাচার করতে শুরু করে দাদ্দা।
২০০৪ সালে পুলিশ ফের পাকড়াও করে দাদ্দাকে। সেই সময়কার এক পুলিশ অফিসার জানান, দাদ্দার বেশ কয়েক জন শাগরেদকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও শিল্পাঞ্চলে মাদকের রমরমা বন্ধ করা যায়নি। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, মাদকের কারবার সামলাচ্ছে দাদ্দারই নিকটাত্মীয়েরা। কিন্তু পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। পরে পুলিশ জানতে পারে, দাদ্দার গ্রেফতারির সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মাদক রাতারাতি এজেন্টদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল তারা। যা পৌঁছে গিয়েছিল বিভিন্ন ঠেকে।
দাদ্দার এক শাগরেদ বর্তমানে জামিনে মুক্ত। সে জানিয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র রাখলেও গোলাগুলি চালানো মোটেই পছন্দ ছিল না দাদ্দার। খুনের বিশেষ পদ্ধতি ছিল তার। ‘টার্গেট’-কে ডেকে, সম্ভব না হলে অপহরণ করে নিজের ডেরায় নিয়ে আসত সে। তার পরে শ্বাসরোধ করে খুন করে বা আধমরা করে রেললাইনের উপরে ফেলে দিত। কিছু দিন তদন্তের পরে ধামাচাপা পড়ে যেত সব। খুনের ঘটনায় পুলিশ দাদ্দাকে ছুঁতেও পারেনি।
২০০৮ সালে দাদ্দার বিরুদ্ধে পথে নামেন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। কারণ, হেরোইনের পুরিয়া সহজেই পৌঁছে যাচ্ছিল এলাকার কম বয়সিদের হাতে। ওই আন্দোলনের জেরে পুলিশ ফের গ্রেফতার করে দাদ্দাকে। বছর দু’য়েক জেলে কাটিয়ে মাদকের কারবার আরও বাড়ায় সে। ওই দু’বছরে দাদ্দার হয়ে তার ভাই চাঁদ এবং তিন মহিলা আত্মীয় কারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে এক জন দাদ্দার শাশুড়ি। মাদক পাচারের দায়ে সে এখন জেলে। মাস ছ’য়েক আগে পুলিশ তাকে ধরেছিল।
মাঝের তিন বছর দাদ্দা অসুস্থ ছিল। সেই সময়ে কারবার সামলাচ্ছিল তার শাশুড়ি। বছরখানেক আগে সুস্থ হয়ে মাদকের সঙ্গে সঙ্গে ফের সুপারি নিতে শুরু করে দাদ্দা। গত এক বছরে তিনটি খুন নিয়ে ধন্দে ছিল পুলিশ। তদন্তকারীরা মনে করছেন, সেই খুনগুলির পিছনে দাদ্দারই হাত রয়েছে। তার মধ্যে মুন্না নামের এক যুবককে সে খুন করিয়েছিল তার শাগরেদ মহম্মদ সালাউদ্দিনকে দিয়ে। কিন্তু সালাউদ্দিনকে চুক্তির পুরো টাকা দেয়নি। সালাউদ্দিন টাকা চেয়ে চাপ বাড়াচ্ছিল দাদ্দার উপরে। সেই জন্য দিন কয়েক আগে তাকে খুন করা হয় বলে দাবি পুলিশের। এ বার আর ছাড় পায়নি দাদ্দা। তার বিরুদ্ধে খুনের প্রমাণ হাতে এসেছে বলে দাবি পুলিশের। ধরা পড়েছে দাদ্দার ভাই চাঁদও। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy