বসিরহাটের প্রাক্তন ক্রিকেটাররা।
দেশ-বিদেশে বসিরহাটের নাম ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম বড় কারণ, ফুটবল। পাশাপাশি অন্যান্য খেলাতেও বসিরহাটের ইতিহাস রীতিমতো গর্ব করার মতো।
১৯৮৫ সালে চাতরা এলাকার বাসিন্দা নরেশচন্দ্র পান্ডে সিঙ্গাপুরে এশিয়ান গেমসে প্রবীণদের হাঁটা প্রতিযোগিতায় সোনার পদক পেয়েছিলেন। বসিরহাটের ছেলে মানস বিশ্বাস দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে সাঁতারে বিচারকের ভূমিকা পালন করেছেন। প্যারাট্রুপার হিসাবে নাম করেছিলেন ধন্বন্তরী চৌধুরী। ভারোত্তোলন এবং জিমন্যাস্টিক দলের হয়ে যদুরহাটির বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ কাবাসি দেশের হয়ে অলিম্পিকে যোগ দিয়েছিলেন। দূরপাল্লার সাঁতারে বহু সম্মান এনেছেন জহর সাহা। বসিরহাটের ক্রীড়া ইতিহাসে আরও এক উজ্জ্বল সংযোজন সাকিনা খাতুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সাঁতারে রাজ্য তথা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে বহু পুরস্কার এনেছেন সাকিনা। সাঁতার ছেড়ে পাওয়ার লিফটিংয়ে ২০১৪ সালে গ্লাসগো (প্যারা) কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে আরও একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানা সময়ে সাফল্য পেয়েছেন আরও অনেকে। কবাডি, ব্যাডমিন্টন, খো-খো, এমনকী হকিতেও সুনাম অর্জন করেছেন বসিরহাটের ভূমিপুত্রেরা। ভলিবল নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা আছে বসিরহাটবাসীর। বহু ভাল খেলোয়াড় উঠে এসেছে এখান থেকে। ক্রিকেটেও রঞ্জি ট্রফি-সহ জাতীয় স্তরে সুনাম কুড়িয়েছেন বসিরহাটের একাধিক ক্রিকেটার।
কিন্তু খেলাধূলার পরিকাঠামো বলতে বসিরহাটকে নিয়ে গর্ব করার কোনও কারণ খুঁজে পান না ক্রীড়ামোদীরা। ভোটের রাজনীতির আবর্তে হারিয়ে যায় খেলাধূলার মানোনন্নয়নের প্রতিশ্রুতিগুলিও।
স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক এবং ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বসিরহাটে মাঠের অভাবটা রীতিমতো ভোগাচ্ছে তাঁদের। বসিরহাট স্টেডিয়াম, প্রান্তিক ময়দান, হাইস্কুল মাঠ, ভ্যাবলা স্কুল মাঠ, হাসপাতাল মাঠ, বিডি তরুণ সঙ্ঘের মাঠ ও সবুজ সঙ্ঘের মাঠই মূলত ব্যবহার হয় খেলাধূলার জন্য। কিন্তু সেই মাঠগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সহজেই নজরে পড়ে। স্টেডিয়াম থাকা সত্ত্বেও কোনও বড় ম্যাচ হয় না বসিরহাটে। তার কারণ, ড্রেসিং রুম নেই এখানে। মাঠে অল্প বৃষ্টিতেই জল দাঁড়িয়ে যায়। বড় বড় ঘাস গজিয়ে বিসদৃশ্য চেহারা সেই মাঠের। মাঝে মাঝে ঘাস ছাঁটা হলেও পাকাপাকি রক্ষণাবেক্ষণের কোনও বন্দোবস্ত নেই।
কিছু দিন আগে শীতকালে একটি মাঠে মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, খেলার মাঠে মেলা হবে কেন? নগরায়ণের দাপটে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র মাঠ আস্ত আছে বসিরহাটে। কিন্তু শীতকালে মেলার আধিক্যে সেখানে খেলাধূলা রীতিমতো ব্যাহত হয়।
মাঠ ভাল না হওয়ায় খেলার উন্নতি ইদানীং তেমন ভাবে হচ্ছে না, এটা ঠিক। স্টেডিয়ামে ড্রেসিং রুম, শৌচালয় এবং মাঠে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরির জন্য সরকার টাকা দিয়েছে। শীঘ্রই কাজ হবে। পুরসভায় আমরা ক্ষমতায় এলে এখানে ভাল মাঠ তৈরির পরিকল্পনা আছে।
দীপেন্দু বিশ্বাস (তৃণমূল)
আমরা পুরসভায় ক্ষমতায় থাকাকালীন স্টেডিয়ামের উন্নতিতে বহু টাকা দিয়েছি। প্রয়াত বিধায়ক তথা পুরপ্রধান নারায়ণ মুখোপাধ্যায় নানা সময়ে খেলাধূলার উন্নতিতে টাকা বরাদ্দ করতেন। ইদানীং খেলাধূলায় বরাদ্দ অনেক বেড়েছে। আমরা ক্ষমতায় এলে খেলাধূলার জন্য আরও টাকা খরচ করা হবে।
নিরঞ্জন সাহা (সিপিএম)
খেলা ও মেলার মাঠ যাতে আলাদা হয়, সেই লক্ষ্য আছে আমাদের। পুরসভায় ক্ষমতায় এলে খেলার জন্য পৃথক মাঠ তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা করা হবে।
অমিত মজুমদার (কংগ্রেস)
রাজ্য ক্লাবগুলিকে টাকা দিয়েই খালাস। খেলার পরিকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেই। পুরসভায় ক্ষমতায় এলে আমরা খেলাধূলাকে অগ্রাধিকার দেব।
শমীক ভট্টাচার্য (বিজেপি)
সাঁতারে এখানকার ছেলেমেয়েরা সাফল্য আনলেও প্রশিক্ষণের কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেই বসিরহাটে। নেই স্যুইমিং পুল। পুকুরে সাঁতার কেটে প্র্যাকটিস করেন সাঁতারুরা। বছর পনেরো আগে বসিরহাট হাইস্কুলের পিছনে একটি পুকুরকে বেছে নিয়ে তাকে স্যুইমিং পুলের আকার দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা অভাবে তা বিশেষ কার্যকর হয়নি। আর অ্যাথলেটিক্সে তো কোনও পরিকাঠামোই নেই বসিরহাটে।
স্থানীয় ক্রীড়ামোদী মানুষের দাবি, পুরসভা যদি উদ্যেগী হত তা হলে বহু ব্যবস্থা করা যেত এখানে। বিশেষত, শহরে যখন এত ভাল ভাল ক্রীড়াবিদ আছে, সেখানে পুরসভা কেন খেলাধূলার মানোন্নয়নে ব্যবস্থা নেবে না?
প্রাক্তন ক্রিকেটার রক্তিমকুমার বসু বলেন, “আগে সর্বত্র বড় বড় মাঠ ছিল। পরিবার থেকে খেলার উত্সাহ পাওয়া যেত বলেই খেলাধূলার মান অনেক ভাল ছিল। এখন জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি খেলার মাঠের অভাব বড়ই চোখে পড়ছে। পুরসভা যদি ভাল মাঠ তৈরির কথা ভাবে, তা হলে বহু ভাল ছেলেমেয়ে খেলার জগতে উঠে আসবে এখান থেকে।” খেলার মাঠে কেন মেলা হবে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
প্রাক্তন ক্রিকেটার তৃপ্তি ব্রহ্ম মনে করেন, খেলাধূলার প্রচুর প্রতিভা থাকলেও স্থানীয় স্তরে তাদের উত্সাহদান তেমন ভাবে চোখে পড়ে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিরও ভাবা উচিত। শুধু মাত্র স্টেডিয়াম তৈরি করেই দায়িত্ব শেষ হয় না। আরও আধুনিক পরিকাঠামো আনা হোক। তা হলে প্রশিক্ষণের জন্য ছেলেমেয়েদের কলকাতামুখী হতে হবে না। এখান থেকে তাদের তৈরি করে আমরা বড় জায়গায় পাঠাতে পারব।” খেলাধূলার সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকেই ভাল মাঠের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
অ্যাথলেট সাকিনা খাতুন বলেন, “এত বড় একটা শহরে একটা স্যুইমিং পুল তৈরি হল না, এটা ভাবতে কষ্ট নয়। ভোটের বাজারে সব দল নানা রকম প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সত্যি যদি পুরসভা খেলাধূলাকে উত্সাহ দিত, তা হলে এখানকার ছেলেমেয়েরা সত্যি উপকৃত হত।”
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy