Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

‘কন্যাশ্রী’ তালিকায় নাম তুলেও বিয়ে বীজপুরে

প্রতিমা বাউরি। বয়স ১৩। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। আর পাঁচটা মেয়ের মতো তারও নাম ছিল কন্যাশ্রী প্রকল্পে। বছরখানেক আগে হঠাত্‌ স্কুলে আসা বন্ধ করে মেয়েটি। কেন আসছে না, তা জানতে শিক্ষকেরা তার বাড়িতে যান। বাড়ির লোক সবিনয়ে তাঁদের জানান, ‘সুপাত্র’ পেয়ে তাঁরা স্কুল-পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। সেই মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে ঘরকন্না করছে।

মৌ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০২
Share: Save:

প্রতিমা বাউরি। বয়স ১৩। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। আর পাঁচটা মেয়ের মতো তারও নাম ছিল কন্যাশ্রী প্রকল্পে। বছরখানেক আগে হঠাত্‌ স্কুলে আসা বন্ধ করে মেয়েটি। কেন আসছে না, তা জানতে শিক্ষকেরা তার বাড়িতে যান। বাড়ির লোক সবিনয়ে তাঁদের জানান, ‘সুপাত্র’ পেয়ে তাঁরা স্কুল-পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। সেই মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে ঘরকন্না করছে।

কেবল প্রতিমা নয়। উত্তর ২৪ পরগনার বীজপুরের মালঞ্চ হাইস্কুলের ওই শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্কুল না পেরিয়েই বিয়ে হয়েছে সায়ন্তনী, পূরবী, শম্পা, সোমাদেরও। গত তিন বছরে এক এক করে স্কুলের ১৫ জন পড়ুয়ার পড়াশোনা এ ভাবেই শিকেয় উঠেছে। খাতা-কলমের বদলে হাতে উঠেছে হাতা-খুন্তি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী প্রতিমা। মালঞ্চের স্কুলটির এক শিক্ষকের আক্ষেপ, “বহু ক্ষেত্রে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে জানতে পারি। তখন কিছু করার থাকে না।”

স্কুল এবং বাসিন্দাদের অভিযোগ, জেটিয়া পঞ্চায়েতের সদস্যদের নাকের ডগা দিয়ে দিনের পর দিন এই ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিবাহ আটকানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। শিশুদিবসে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মিছিল বের করা হয়। শিক্ষকদের কথায়, “অল্প বয়সে বিয়ে দিলে কী ক্ষতি হতে পারে, এ বিষয়ে ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বহুবার অভিভাবকদের বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ফল হয়নি।”

দারিদ্রের জন্য সাত তাড়াতাড়ি মেয়েকে পার করে দিচ্ছেন বাবা-মা, এমনও সব ক্ষেত্রে বলা চলে না। অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েরও কৈশোরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে গ্রামের বাসিন্দা এক মহিলা যুক্তি দিলেন, “বয়স বেড়ে গেলে ভাল ছেলে পাওয়া যাবে না। তখন মেয়ে নিয়ে কোথায় ঘুরব?”

তাই জঙ্গলমহল কিংবা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, কলকাতার উপকণ্ঠেই একের পর এক নাবালিকা বিবাহ ঘটে চলেছে। কলকাতা থেকে মাত্রই ৫০ কিলোমিটার দূরে বীজপুর থানা। তার অধীনে জেটিয়া পঞ্চায়েতের মালঞ্চ গ্রামে নিঃশব্দে ঘটে চলেছে নাবালিকা বিবাহ। গত কয়েক বছরে পুরুলিয়া, মুর্শিদবাদের মতো নানা গরিব জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাবালিকার বিয়ে আটকানোর খবর মিলছে। অতি সম্প্রতি পুরুলিয়ার মানবাজারে এলাকার লোকেদের কাছে জানতে পেরে বিডিও এক নবম শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে রুখেছেন। মাস ছয়েক আগে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা-২ ব্লকে বিডিও নিজে গিয়ে রুখেছেন পনেরো বছরের মেয়ের বিয়ে। তা হলে উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলায় এই অপরাধ অবাধে চলছে কী করে? ব্যারাকপুরের এসডিও পূর্ণেন্দু মাঝি এ প্রসঙ্গে বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখছি বীজপুরে এমন ঘটনা ঘটছে কিনা। তার পর প্রয়োজনায় ব্যবস্থা নেব।”

জেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান কানু সরকারের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। বীজপুর থানার পুলিশ কর্মীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। তাই কোনও ব্যবস্থা নিতে পারিনি। খবর পেলে নিশ্চই বিয়ে আটকাব’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর ২৪ পরগনার শিশু সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সরকারি আধিকারিক এই প্রসঙ্গে বলেন, “নাবালিকার বিয়ে দিলে বাবা-মা গ্রেফতার হতে পারেন। তা-ও অনেক জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এই প্রথা পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য ব্লক স্তরে এবং গ্রাম স্তরে শিশু সুরক্ষা সমিতি (চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটি) গড়ছি। তাতে তত্‌পরতা বাড়বে।”

তিন বছরে একই স্কুলের ১৫ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেলেও কেন এখনও তত্‌পর হল না পুলিশ-প্রশাসন, সে প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই গিয়েছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE