বামেদের ভোটে ভাগ বসিয়ে লোকসভা ভোটে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়েছে বিজেপি। তার পরেও রাজ্যে তাদের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। জেলায় জেলায় নিচু তলার বাম কর্মী-সমর্থকদের অনেকে নাম লেখাচ্ছেন গেরুয়া শিবিরে। রাজ্যে বিরোধী পরিসরের অনেকটাই দখল করে নিচ্ছে বিজেপি। এই অবস্থায় বিজেপি-র রাজনৈতিক মোকাবিলা এখন কোন পথে হবে, সেই প্রশ্নে গভীর উদ্বেগের মধ্যে পড়েছে দুই বাম দল সিপিএম এবং সিপিআই।
দিল্লিতে সিপিএমের দু’দিনের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কলকাতায় সিপিআইয়ের দু’দিনের রাজ্য কর্মসমিতি দুই বৈঠকেই উঠেছিল বিজেপি-মোকাবিলার প্রশ্ন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা কখনও আপস করেননি, এই নিয়ে এত দিন প্রচ্ছন্ন গর্বই অনুভব করতেন বাম নেতৃত্ব। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বিজেপি-র বিরুদ্ধে শুধু সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে কাজ হবে কি না, তা নিয়ে দু’দলের অন্দরেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষত, তরুণ প্রজন্ম যে ভাবে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকছে, তা আরও কোণঠাসা করে দিচ্ছে বামেদের। পরিস্থিতি যাচাই করে সিপিএম এবং সিপিআইয়ের মধ্যেই একাংশের প্রস্তাব, শুধু সাম্প্রদায়িকতার কথা না-বলে বিজেপি-র বিরুদ্ধে আক্রমণের অভিমুখ বেশি করে ঘুরিয়ে দেওয়া হোক তাদের অর্থনীতির দিকে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক বর্ষীয়ান সদস্যের বক্তব্য, বামেদের বিজেপি-বিরোধী প্রচার যে আদৌ জনমানসে বিশেষ দাগ কাটছে না, তার আঁচ লোকসভা ভোটের আগেই মিলেছিল। কয়েক মাস আগে রাজস্থানে বিধানসভা ভোটের প্রচারে অশোক গেহলৌতের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতির পাশাপাশি বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতার তীব্র বিরোধিতা করেছিল সিপিএম। বলা হয়েছিল, দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি এলে আরও বিপদ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি-ই। সিপিএমের তিন বিধায়কই পরাস্ত হন, কয়েকটি জেলায় গড়ে-ওঠা সংগঠন গেরুয়া-ঝড়ের মুখে কিছুই করতে পারেনি! ওই নেতার যুক্তি, লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রবণতারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই সিপিএমের অন্দরে দাবি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি যে মনমোহন সিংহের বিগত সরকারের চেয়ে ভিন্ন নয়, এ প্রচারকেই বেশি করে সামনে আনা হোক।
তবে সেখানেও সমস্যা হচ্ছে, মোদীর সরকারের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে জনমানসে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার আগে বামেদের প্রচারে কেউ কান দিতে না-ও পারেন। যদিও দলের একাংশের মত, এখন থেকেই এই প্রচার গড়ে তুলতে পারলে সত্যিই কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সিদ্ধান্তে ক্ষোভ তৈরি হলে তার ফায়দা নেওয়া যাবে। নইলে আবার লাভের গুড় খেয়ে যাবেন সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! প্রশ্ন উঠেছে, লোকসভা ভোটের প্রচারে তৃণমূল নেত্রী তো মোদীকে সেই ‘দাঙ্গার মুখ’ বলেই টানা আক্রমণ করে গিয়েছেন। তা হলে তাঁর দল এত ভোট পেল কী করে? সিপিএমের মধ্যে একাংশের ব্যাখ্যা, মমতার হাতে রাজ্যের প্রশাসন আছে। নিরাপত্তা পাওয়ার আশায় সংখ্যালঘুদের বড় অংশ তাই তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছেন। শুধু রাজনৈতিক প্রচারে বামেদের পক্ষে এখন ওই সমর্থন পাওয়া কঠিন।
বিজেপি অবশ্য সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ধীরে ধীরে ভিত্তি প্রসারিত করতে চাইছে। বীরভূমের ইলামবাজারের ঘটনার পূর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে তারা যেমন তৎপর হয়ে ময়দানে নেমেছে। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “লোকসভা ভোটে বিজেপি-র বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার কোনও অংশে দুর্বল ছিল না। কিন্তু তবুও মানুষ আমাদের উপরে কেন আস্থা রাখেননি, সেটাই খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। ভোটের ফল যা-ই হোক, বিজেপি-বিরোধিতায় আমাদের তরফে কোনও শিথিলতা থাকবে না!”
শনি ও রবিবার কলকাতায় সিপিআইয়ের রাজ্য কর্মসমিতির বৈঠকেও জেলা নেতারা বিজেপি-র উত্থানের কথা বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু হাতে-গরম কোনও মোকাবিলা-সূত্র সেখান থেকে বেরোয়নি। সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “তৃণমূল আর বিজেপি-র লড়াই হবে আমাদের আর বসে থাকার সুযোগ নেই! তবে বেশি বিজেপি, বিজেপি করতে গিয়ে তৃণমূল-বিরোধিতায় ঢিলে দিলে চলবে না। ভেবেচিন্তে আমাদের পা ফেলতে হবে।” সিপিআইয়ের অস্বস্তি বাড়িয়ে তাদের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য অশোক সেনাপতি বিজেপি-তে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, বামেদের তরফে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সে ভাবে প্রতিবাদ-আন্দোলন হচ্ছে না! ওই জেলারই ফরওয়ার্ড ব্লকের পদত্যাগী জেলা সভাপতি সুকুমার ভুঁইয়া একই পথে পা বাড়িয়ে রেখেছেন বলে বিজেপি সূত্রের ইঙ্গিত। আরএসপি-র বর্ধমান জেলা সম্পাদক অঞ্জন মুখোপাধ্যায় আগেই বিজেপি-তে যাওয়ার ইচ্ছা ঘোষণা করে দিয়েছেন। এমন ভাঙন ঠেকাতেই এখন পথ হাতড়াতে হচ্ছে বাম নেতৃত্বকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy