বসিরহাটে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের রেল অবরোধ। বৃহস্পতিবার। ছবি: নির্মল বসু।
কয়েক বছর আগে অবরোধ-ভাঙচুরে বাংলা বন্ধ ‘সফল’ করে নজর কেড়েছিল বিজেপি। কিন্তু সে ছিল বিক্ষিপ্ত কর্মসূচি। লোকসভা ভোটে বেনজির সাফল্যের পরে এ বার রাজ্য জুড়ে সংগঠিত ভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বৃহস্পতিবার তাদের শক্তিবৃদ্ধির প্রমাণ দিল বিজেপি।
সন্দেশখালি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দলের কর্মী-সমর্থকদের উপরে শাসক দলের আক্রমণের প্রতিবাদে এ দিন রাজ্য জুড়ে থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি। বসিরহাট মহকুমায় ডাকা হয়েছিল ১২ ঘণ্টার বন্ধ। কলকাতা-সহ রাজ্যের সর্বত্রই এ দিন বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘিরে বিজেপি-র কর্মী-সমর্থকদের উৎসাহ চোখে পড়েছে। বিজেপি-র এই বাড়বাড়ন্ত যে শাসক দলের কাছে উদ্বেগের কারণ, তার প্রমাণও মিলেছে এ দিন। বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে দুর্গাপুরে তৃণমূলের আক্রমণের মুখে তাদের পড়তে হয়েছে বলে বিজেপি-র অভিযোগ। দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে ঘটনাপ্রবাহের খবর পেয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজ্যের দুই সদ্যনির্বাচিত সাংসদ-সহ পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের কাল, শনিবার সন্দেশখালি ঘুরে রাজ্যের মুখ্যসচিব বা রাজ্য পুলিশের ডিজি-র কাছেও যাওয়ার কথা।
পশ্চিমবঙ্গে দলের জন্য তৈরি হওয়া নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও যে উদগ্রীব, প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্তে তারই ইঙ্গিত রয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের ব্যাখ্যা। এর আগে বাজপেয়ী সরকারের জমানায় রাজ্যে এনডিএ-র প্রতিনিধিদল এসেছিল একাধিক বার। তবে তার বেশির ভাগ ছিল বিজেপির তৎকালীন জোটসঙ্গী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে। এ বার বিজেপি-র পদক্ষেপ একেবারেই নিজস্ব তাগিদে।
রাজ্য জুড়ে এ দিন বিজেপি-র বিক্ষোভের যে ছবি দেখা গিয়েছে, তাতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উৎসাহিত হওয়ারই কথা। নানা জেলাতেই এ দিনের বিক্ষোভে লোক জড়ো করতে সফল হয়েছিল বিজেপি। এই সে দিন পর্যন্ত যা ছিল তাদের কাছে অভাবনীয়! লোকসভা ভোটে এ বার এ রাজ্যে দু’টি আসন জেতার পাশাপাশি প্রায় ১৭% ভোট পেয়েছে তারা। রাজ্যের মোট ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে হাতে-গোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে প্রায় সর্বত্রই আগের চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়েছে তারা। কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অন্যান্য দল থেকে কর্মী-সমর্থকেরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন। সেই তালিকায় রয়েছে শাসক দল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরাও। দলের বাড়বৃদ্ধির প্রতিফলন এ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন বিজেপির নেতারা। আর রাজ্যে পায়ের তলায় মাটি শক্ত হচ্ছে বুঝেই বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও রাজ্য নেতাদের আর্জিতে সাড়া দিয়েছেন।
সন্দেশখালির ঘটনা-সহ রাজ্যে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের কথা বুধবার রাতেই দলের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে জানিয়েছিলেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। দুর্গাপুরের লাউদোহা থানায় বিক্ষোভ দেখিয়ে ফেরার পথে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উপরে তৃণমূলের হামলার অভিযোগও এ দিন রাজনাথের গোচরে আনেন আসানসোলের সাংসদ বাবুল। তার পরেই প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন রাজনাথ। কেন্দ্রীয় নেতা মুখতার আব্বাস নকভি, দলের মুখপাত্র মীনাক্ষি লেখি এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে পশ্চিমবঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ওই দলে থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন এ রাজ্যের দুই সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া (নকভির মতোই যিনি বিজেপি-র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি) এবং বাবুল। সন্দেশখালিতে আক্রান্ত এলাকা ঘুরে এসএসকেএম হাসপাতালে আহতদের দেখে কাল তাঁদের যাওয়ার কথা মুখ্যসচিব বা ডিজি-র কাছে। রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথের কথায়, “রাজ্য জুড়ে বিজেপি কর্মীদের উপরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের যে হামলা শুরু হয়েছে, তা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা বুঝিয়ে দিতে চাই, এই জিনিস আমরা বরদাস্ত করব না!”
তবে রাজনৈতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে রাজ্যে দলীয় প্রতিনিধিদল পাঠালেও সরকারি স্তরে লক্ষ্মণরেখা মেনে চলারই চেষ্টা করছে মোদীর সরকার। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব চেয়েছিলেন, রাজনাথের নির্দেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজভির নেতৃত্বে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল এসে সন্ত্রাস-কবলিত এলাকা ঘুরে দেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিক। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা যে হেতু রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় এবং মোদী ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন, এর পরে এখনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দল পাঠালে সেই ঘটনাকে হাতিয়ার করার সুযোগ পেয়ে যেতেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনাথেরা তাই ভেবেচিন্তেই দলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের প্রতিক্রিয়াও তাই এখনও সংযত। আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খুলতে না-চাইলেও দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, “সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠালে তখন অন্য ভাবে দেখতে হতো। রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি তাদের কাজ করতেই পারে।” রাজ্যের মন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বিজেপিকে প্রায় চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। তাঁর দাবি, “বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে। আমাদের কর্মীদের বাড়িতে (সন্দেশখালি) বোমা মেরে উত্তেজনা তৈরি করেছে। ওরা প্রমাণ করুক, কারও গুলি লেগেছে!” তাঁর আরও বক্তব্য, “প্রতিনিধিদল আসছে, আসুক! কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি আমরা রুখব!”
বিজেপি-র উত্থান এবং বাড়তি তৎপরতা তৃণমূলের মতোই চিন্তায় ফেলেছে বামেদেরও। এমনিতেই এ বার বামেদের ভোটে বড়সড় ভাগ বসিয়ে ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। এর পরে রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির পরিসরও দখল নেওয়ার পথে হাঁটছে তারা। চুপচাপ বসে থাকলে আরও জমি হারাতে হবে আশঙ্কা করেই সন্দেশখালি নিয়ে আসরে নেমেছে বামেরাও। বিজেপির মতোই এ দিন বসিরহাটে বন্ধের ডাক দিয়েছিল জেলা বামফ্রন্টও। বুধবার আক্রান্ত এলাকায় গিয়েছিলেন সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রেখা গোস্বামীর মতো সিপিএমের নেতা-নেত্রীরা। তার পরে এসএসকেএম হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যবাবুর ব্যাখ্যা, আহতেরা সকলে বিজেপি-র কট্টর কর্মী-সমর্থক নন। তাঁরা গ্রামবাসী, শাসক দলকে ভোট না দেওয়ার ‘অপরাধে’ যাঁদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। তাই বিরোধী দল হিসেবে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন সূর্যবাবুরা। আহতদের এসএসকেএমে নিয়ে আসতেও ভূমিকা নিয়েছিলেন সন্দেশখালির সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দার।
বসিরহাট মহকুমায় বামফ্রন্ট বন্ধ ডেকে রাখলেও অবরোধ-বিক্ষোভে এ দিন কিন্তু পথে নেমেছিল বিজেপি-ই। বিভিন্ন স্টেশনে দফায়-দফায় রেল অবরোধ করেছে তারা। বন্ধে অনেক সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। বাস চলেনি প্রায় কোথাও। তবে সন্দেশখালির যে গ্রামে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উপরে তৃণমূলের হামলার অভিযোগে এত কিছু, সেই হালদারঘেরি পাড়ায় কিন্তু বন্ধের কোনও প্রভাবই পড়েনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy