এ যেন ‘লাগে রহো মুন্নাভাই’-এর ‘গেট ওয়েল সুন’ ফুলের তোড়া!
প্ল্যাকার্ডে লাল-কালো কালিতে লেখা ‘১৭ই সেপ্টেম্বর, ভুলছি না, ভুলব না। পুলিশ তুমি হুঁশিয়ার’। সঙ্গে এক তোড়া গোলাপ। আর এক মুঠো লজেন্স। মঙ্গলবার যাদবপুর থানার সামনে দিয়ে মিছিল করে যাওয়ার সময় থানার সদর দরজার সামনে ওই প্ল্যাকার্ড-সহ ফুল আর লজেন্স রেখে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা।
১৭ সেপ্টেম্বর রাতে উপাচার্যের ডাকে ক্যাম্পাসে ঢুকে যথেচ্ছ কিল-চড়-ঘুষি মেরে আর বুটে পিষে ঘেরাও হটিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। সেই পড়ুয়া পেটানোর প্রতিবাদে চার মাস আগেও মিছিল বার করেছিলেন যাদবপুরের পড়ুয়ারা। তখন যাদবপুরের পুলিশের উদ্দেশে ধিক্কার জানিয়ে থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা।
মঙ্গলবারের মিছিলে পা মিলিয়ে অবশ্য কোনও রকম ঘেরাও-বিক্ষোভে না-গিয়ে পুলিশের প্রতি গাঁধীগিরি দেখালেন আন্দোলনকারীরা।
মূলত যে-দাবিতে পড়ুয়ারা চার মাস আগে পথে নেমেছিলেন, তা পূরণ হয়েছে। উপাচার্যের পদ ছেড়েছেন অভিজিৎ চক্রবর্তী। সোমবার রাতে আচমকাই যাদবপুর ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের ইচ্ছের কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চার মাস ধরে একটানা আন্দোলন করার পরে সরকারের এই পদক্ষেপকে এক রকম নিজেদের জয় বলেই মনে করছেন ছাত্রছাত্রীরা। মঙ্গলবারের মিছিল সেই জন্যই। এ দিন সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের মুখ্য আলোচ্য ছিল সোমবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা ক্যাম্পাসে আগমন। একই সঙ্গে ছোট ছোট জটলা করে ছন্দ মিলিয়ে একটানা চলতে থাকে হাততালি আর ‘হোক কলরব’ স্লোগান। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ দেখতে পাওয়া বন্ধুকে আলিঙ্গন করে কাঁদতেও দেখা গিয়েছে অনেক ছাত্রছাত্রীকে। লাল, হলুদ, নীল আবিরে এ দিন ক্যাম্পাস জুড়ে একটাই আমেজ ছিল ‘আজাদি’।
গাঁধী ভবনের সামনে জমায়েত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে বড় শিক্ষক সংগঠন জুটা-র সদস্যেরা। তাঁদের বক্তব্য, উপাচার্যকে নানা ভাবে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি কারও কথা শুনছিলেন না। সে-দিক থেকে সরকারের হস্তক্ষেপের পরে উপাচার্যের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন তাঁরা। তবে বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে জুটা-র এক সদস্য জানান, আশা করা হচ্ছিল, আচার্য তথা রাজ্যপালের হস্তক্ষেপেই উপাচার্যকে সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু তা হয়নি। উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন ঠিকই। তবে যাঁর কথায় যে-ভাবে করেছেন, তা কিছুতেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। “তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আমাদের আন্দোলন চলবেই,” বললেন তিনি।
এ দিন বেলা ২টো নাগাদ গাঁধী ভবনের সামনে থেকে জুটা-র মিছিল বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিক্রমা করে ফের গাঁধী ভবনের সামনে এসেই শেষ হয়। তার পরে সাধারণ সভার বৈঠক করে পরবর্তী কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় জুটা। ওই সংগঠনের এক সদস্য জানান, অভিজিৎবাবু উপাচার্য থাকাকালীন গবেষণা এবং অন্যান্য বিষয়ে যে-ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, এই সপ্তাহেই তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন জুটা-র প্রতিনিধিরা। ইন্টারনাল কমপ্লেন্টস কমিটি (আইসিসি) পুনর্গঠন এবং ফেস্টের দিন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলিও ওই আলোচনায় তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছে জুটা।
পড়ুয়ারাও জানাচ্ছেন, আন্দোলন এখানেই শেষ নয়। অরিত্র মজুমদার নামে আন্দোলনকারী এক ছাত্র বলেন, “আন্দোলন চলবেই। আমাদের প্রধান দাবি মানা হয়েছে। অন্য দাবিগুলো নিয়ে এ বার বিশ্ববিদ্যালয়-কতৃর্র্পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে।”
তবে আপাতত শুধুই জয়োল্লাস। এ দিন বিকেল ৪টে নাগাদ যাদবপুর ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল বেরোয়। পুলিশি সূত্রের খবর, মিছিলে প্রায় দু’হাজার পড়ুয়া ছিলেন। সুবোধ মল্লিক রোড ধরে মিছিল এগোনোর সময় বিভিন্ন সিগন্যালে সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশও নামানো হয়েছিল বলে এক পুলিশকর্তা জানান। মিছিলে যোগ দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের উচ্ছ্বাস কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন পথচলতি মানুষ আর স্থানীয় লোকজন। রাস্তার ধারের বাড়ির বারান্দা ও জানলা থেকে হাততালি দিতে দেখা গিয়েছে বাসিন্দাদের।
মিছিলের প্রথম সারিতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনশনরত পড়ুয়ারাও ছিলেন। তাঁদেরই এক জন, পায়েল সরকার সোমবার অনশন মঞ্চে অসুস্থ হয়ে পড়ায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ দিন তিনি বলেন, “বন্ধুর এসএমএস পেয়ে তখনই আমায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে থাকি। কিন্তু ছুটির অনুমতি মেলেনি। তাই বন্ধুরা এসে সারা রাত আমার সঙ্গে হাসপাতালে ছিল। এ দিন সকালে ছাড়া পেতেই সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। এই জয়ের বিকল্প হয় না।”
যাদবপুরের পড়ুয়াদের মিছিলকে অভিনন্দন জানাতে গড়িয়াহাট সেতুর মুখে ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মুরলীধর কলেজের ছাত্রী সংগঠনের সদস্যারা।
অপর্ণা ওঝা নামে এক সদস্যার কথায়, “আমরা শুরু থেকেই এই আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। আন্দোলনকারীদের সহমর্মিতা জানাতে এ দিনও এসেছি আমরা। ওঁদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy