ছাত্রদের ঘেরাও আন্দোলন মোকাবিলায় গভীর রাতে পুলিশ ডেকে শুধু বিরোধীদের হাতে প্রতিবাদের নতুন হাতিয়ারই তুলে দিলেন না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। রাজ্য সরকারকেও বসিয়ে দিলেন প্রেশার কুকারের উপরে!
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভিন্ন সুর উঠে এসেছে সরকারের মধ্যে থেকেই। বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রদের আন্দোলন মোকাবিলায় এ ভাবে পুলিশ ডাকা তিনি সমর্থন করেন না। কর্তৃপক্ষের আরও সংযত হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। ছাত্র পরিষদের এক সময়ের ডাকসাইটে নেতা সুব্রতবাবুর এই বিষয়ে মতামত দেওয়ার অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা নিয়ে কোনও মহলেই যে হেতু কোনও সংশয় নেই, তাই শাসক দল ও রাজ্য সরকারের এতে আরও বেশি করে বিড়ম্বনায় পড়ার কথা!
বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে তুলেছেন সরকারেরই আর এক মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। পুলিশের আচরণকে সমর্থন না করে বুধবার সকালে টিভি চ্যানেলে কিছু বিবৃতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ববি। যার জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় শিক্ষা দফতরে। পূর্ত ও নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ববি কেন শিক্ষার বিষয়ে এমন মতামত দিচ্ছেন, প্রশ্ন উঠে যায় তৃণমূল এবং প্রশাসনের অন্দরে। বিতর্কের আঁচ পেয়ে পরে মুখে কুলুপ আঁটেন ববি!
তবে ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন নেতা সুব্রতবাবু তাঁর মনোভাব গোপন করেননি একেবারেই। তাঁর পরিষ্কার কথা, “ছাত্র আন্দোলন অত ব্যাকরণ মেনে হয় না! ওরা আবেগপ্রবণ। সরল, নির্মল। তাদের বুঝিয়ে সামলাতে হয়। ভাল ব্যবহার করলে তারা কথা শুনবে, বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড়ও কেচে দেবে! তবে অন্য সুরে যদি কথা বলা হয়, তা হলে মরে যাবে, কিন্তু নিজেদের জায়গা থেকে নড়বে না!” নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সুব্রতবাবুর আরও সংযোজন, “আমাদের ছাত্র জীবনে এ রকম হলে প্রধান শিক্ষক বা উপাচার্যেরা বুক দিয়ে আগলাতেন! পুলিশ ডাকার ঘটনা ঘটতই না। তখন এমন উপাচার্যও ছিল না, ছাত্রও না!” তিনি নিজেও কংগ্রেস জমানায় পুলিশমন্ত্রী ছিলেন। সেই সময়েও তিনি সাবধানে পরিস্থিতি সামলাতেন বলে মন্তব্য করেছেন সুব্রতবাবু।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর দলের বর্ষীয়ান নেতার কথার উপরে কোনও মন্তব্য করেননি। তার উপরে পুলিশমন্ত্রী যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে শাসক দলের অন্দরে স্পর্শকাতরতা আরও বেশি! তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য বলেছেন, “সুব্রতদা তো দিদিরও নেতা। তিনি অবান্তর কিছু বলেননি! ঘটনা যা ঘটেছে, তাতে শিক্ষামন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী কারও পক্ষেই স্বস্তিজনক কিছু হয়নি!”
সুব্রতবাবুর কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গিয়েছে এ রাজ্যে ছয় বা সাতের দশকে বাম ছাত্র আন্দোলনের দাপুটে নেতাদের গলায়। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন ছাত্র-নেতা শ্যামল চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, “পুলিশের কাছে মার আমরাও খেয়েছি। কিন্তু রাস্তায়। কলেজে ঢুকে কোনও দিন পুলিশ আমাদের সে যুগেও মারেনি। তেমন হলে শিক্ষকরাই রুখে দিতেন!” আর এক প্রাক্তন ছাত্র-নেতা এবং অধুনা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কথায়, “যাদবপুরে পুলিশ ঢুকে আলো নিভিয়ে যে ভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পিটিয়েছে, অতীতে এমন ঘটনা শুনিনি। কংগ্রেস আমলে আমরাও অনেক রাত পর্যন্ত আন্দোলন করেছি। তার পরে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলে আলাপ-আলোচনা করে ধর্না তুলে নিতাম। তখন অবশ্য অন্য রকম উপাচার্য ছিলেন! এখানেও তো আলোচনায় বসেই সমস্যা সমাধান করা উচিত ছিল।”
যাদবপুরের ঘটনাকে হাতিয়ার করে পথে নেমে পড়ারও সুযোগ পেয়ে গিয়েছে বিরোধীরা। সারদা-কাণ্ডের মধ্যেও খাস কলকাতায় চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয় এবং বসিরহাটে অল্প ব্যবধানে হার শাসক দলকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যাদবপুরের ঘটনা বিরোধীদের নতুন অক্সিজেন দিয়েছে, শাসক দলকেও কিছুটা চাপে ফেলেছে। বুধবার সকালে সাংসদ তথা ছাত্র-নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পথ অবরোধে নেমে পড়ে এসএফআই। আহত ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং যাদবপুরেরই প্রাক্তনী, সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী। রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ এবং দোষীদের শাস্তি চেয়েছে বিজেপি এবং সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “উপাচার্যের ছদ্মবেশে ওই ব্যক্তি তৃণমূল কর্মী হিসাবে কাজ করছেন!”
ঘটনার প্রতিবাদে যাদবপুর ক্যাম্পাসে দফায়-দফায় সভা করে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ দাবি করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। প্রকাশ্য সভাতেই মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে। নিগ্রহকারীদের শাস্তি না-হওয়া পর্যন্ত যাদবপুরে পঠনপাঠন অচল করে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এ দিন বিকেলে ধিক্কার মিছিলে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই যোগ দেন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও। ছিলেন বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের কর্মী, শিক্ষক, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, লেখক, শিল্পীরা। উপাচার্য ও পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন অভিনেতা কৌশিক সেন, নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষের মতো বিশিষ্টেরা। এমনকী, মমতা-ঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের পরামর্শ দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর।
এসএফআই-সহ চারটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন আজ, বৃহস্পতিবার ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন পিএসইউ নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আজই ঢাকুরিয়া থেকে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি। তাদের লক্ষ্য, ওই মিছিল বৃহত্তর চেহারা নিক। সাংসদ ঋতব্রতর কথায়, “বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জন্য। বোমা বাঁধার জন্য নয়! যাঁরা এটাই মনে করেন, তাঁদের সকলকে মিছিলে আহ্বান জানাচ্ছি।” অন্য কোনও সংগঠন তাদের ব্যানার নিয়ে যোগ দিলেও আপত্তি নেই বলে এসএফআই নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন।
রাজ্য সরকারকেই নিশানা করে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু এ দিন বলেছেন, “অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। অন্ধকারের জীবেরা রাতের অন্ধকারে কাজ সেরেছে!” সরকারি মুখপাত্রের মতো কাজ করা উপাচার্য যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেন, তত মঙ্গল বলেও মন্তব্য করেছেন সূর্যবাবু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য, তাণ্ডব নতুন কী! এই সরকার আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু রাখেনি!” অধীরের তালুক বহরমপুরে প্রতিবাদ মিছিলও করেছে ছাত্র পরিষদ।
তবে এর মধ্যে তাদের সাম্প্রতিক ঐতিহ্যই বজায় রেখেছে রাজ্য মহিলা কমিশন। ছাত্রীদের মার খাওয়া বা শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন মহিলা কমিশনের সদস্য, তৃণমূলের নেত্রী দোলা সেন। তাঁর মন্তব্য, “পাগলে কী না বলে! যাদবপুরে একটা ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। পুলিশ প্রহরায় উপাচার্যকে বার করে আনা হয়েছে। ব্যাস! এর বাইরে নারী হেনস্থা হয়নি।” কমিশনের অন্দরের লড়াইয়ের প্রতিফলন অবশ্য এ দিনও বেরিয়ে এসেছে। কারণ এই বিষয়ে দোলার সঙ্গে তিনি একমত নন বলে কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তাঁর এখন নিজে থেকে এগিয়ে এসে কিছু করার নেই। সুনন্দাদেবীর কথায়, “আমার বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ এটা মেনে নেবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy