শিক্ষাঙ্গনে পুলিশ ডেকে নয়, আলোচনায় ডাকা অথবা ঘেরাও হয়ে থাকা— এই দুই অস্ত্রে ছাত্র আন্দোলন মোকাবিলা অনেক সহজ হয় বলে মনে করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসকদের একাংশ থেকে প্রাক্তন কয়েক জন উপাচার্য-রেজিস্ট্রাররা সকলেই। যাদবপুরে পুলিশ ডেকে যে ভাবে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ রুখে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, সেই পন্থা তাই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
“আমি স্তম্ভিত, মর্মাহত! টিভি-তে যা দেখেছি, তা কল্পনাও করতে পারছি না।” বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য তথা এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের (ইসি) সদস্য সিদ্ধার্থ দত্ত বুধবার এই মন্তব্য করেন। তাঁর কথায়, “আমার পড়াশোনা যাদবপুরেই। ৩২ বছর ধরে এখানেই শিক্ষকতা করেছি। কখনও পুলিশ ডেকে ছাত্র-আন্দোলন ভাঙার কথা মাথায় আসেনি। মঙ্গলবার রাত সওয়া দু’টোয় বাড়ি ফিরেছি। তখনও জানি না এ রকম হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকার সিদ্ধান্ত একান্তই উপাচার্যের।” বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম রেজিস্ট্রার ও অফিসার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুবীর চক্রবর্তী বলেন, “আমি তখন (২০০৫-০৬) ইসি-র সদস্য ছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম, ছাত্ররা যতক্ষণ ইচ্ছে ঘেরাও করে রাখুক, পুলিশ ডাকব না। কোনও দিন ডাকিওনি।”
তথ্য বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ক্লোজড সার্কিট টিভি-বসানো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২০১০-এ ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা তৎকালীন উপাচার্য প্রদীপনারায়ণ ঘোষ-সহ পদস্থ কিছু কর্তাকে ঘেরাও করেন। প্রশাসকদের হুমকি দেওয়া হয়, বাইরে বেরোতে হলে পড়ুয়াদের বুকের উপর দিয়ে যেতে হবে। তাঁদের এই মনোভাব বদলাতে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আসরে নামেন শিক্ষক সংগঠন ‘জুটা’ এবং ইসি-র প্রতিনিধিরা। আন্দোলনরত পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁরা দফায় দফায় কথা বলেন। শেষে ৫২ ঘণ্টা বাদে ঘেরাও ওঠে। প্রদীপবাবু এখন বিদেশে। তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
বিভিন্ন দাবিতে ছাত্রদের ঘেরাওয়ের শিকার হয়েছেন আরও কয়েক জন উপাচার্য। তাঁদেরই এক জন অশোকনাথ বসু। এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “১৯৯৮ থেকে ২০০৬— দীর্ঘ ওই সময়টায় আমি যাদবপুরের উপাচাযর্র্ ছিলাম। কোন অবস্থায়, কবে, কারা ঘেরাও করেছিল— মনে নেই। তবে কখনও পুলিশ ডেকে ছাত্র হটানোর কথা মাথায় আসেনি।” মঙ্গলবার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “আমি কলকাতার বাইরে। গত রাতের ঘটনা জানি না। তাই মন্তব্য করব না।”
বছর আটেক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’নম্বর গেটের সামনে ছাত্র-সংগঠন ‘ফেটসু’-র কিছু প্রতিবাদী অনশন শুরু করেন। সুবীরবাবু বলেন, “আমি ওই সময়ে কিছু দিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও প্রতি রাতে ওঁদের কাছে যেতাম। কটু কথা শুনতে হত, তবু খোঁজ করতাম। কারণ, ওঁরা আমাদের ছাত্র।” বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, আন্দোলন চলাকালীন এক ছাত্র অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে বলেন চিকিৎসকেরা। ছেলেটিকে হাসপাতালে পাঠাতে জেলা প্রশাসকের দ্বারস্থ হন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে পুলিশি সহায়তায় অসুস্থ ছাত্রটিকে সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়।
’৯৮ থেকে প্রায় ১১ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ছিলেন রজত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “হাসপাতাল থেকে এক দিন বাদে ওই ছাত্রকে ছাড়া হয়। পরের দিন আমি ডিন-কে হাওড়ায় ওঁর বাড়িতে পাঠাই।” রজতবাবুর বক্তব্য, “কারখানার শ্রমিক আর পড়ুয়া— পুলিশের লাঠি দিয়ে দুই চরিত্রের আন্দোলনকে দমন করা যায় না।” তাঁর দাবি, “আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু পুলিশ ডেকে ছাত্রদের হটানো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কলুষিত করল।” সে দিন ছাত্রটিকে হাসপাতালে নিতে পুলিশ এলেও তারা ভিতরে ঢোকেনি বলে দাবি রজতবাবুর।
নয়ের দশকের মাঝে সুবোধ সোম এবং তার পরে শ্যামলকান্তি সান্যাল উপাচার্য থাকাকালীন তাঁরাও ঘেরাও হন। দু’জনেই প্রয়াত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আধিকারিক বলেন, “তখনও পুলিশ ডাকতে হয়নি”।
১৯৯৯ সালে গ্রন্থাগারের ফি-বৃদ্ধির প্রতিবাদে যাদবপুরে উত্তাল আন্দোলন হয়। ২০০৩-এ পরীক্ষার নিয়মকানুন বদলের দাবিতেও তৎকালীন উপাচার্য-সহ পদস্থ আধিকারিকদের টানা ঘেরাও হতে হয়েছিল। এ কথা জানিয়ে রজতবাবু বলেন, “দু’টি ক্ষেত্রেই ছাত্রদের দাবি মেনে সমস্যা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিশন করেছিল সরকার।” তাঁর দাবি, ছাত্রদের কণ্ঠরোধে পুলিশের দরকার হয়নি।
যাদবপুরের গণ্ডী ছাড়িয়ে ঘেরাও হতে হয়েছিল সন্তোষপুর ঋষি অরবিন্দ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি ঘোষকে। ২০১২-র ডিসেম্বরে একদল মহিলা সহকর্মীকে নিয়ে রাতভর ঘেরাও থেকেও পুলিশকে বলেছিলেন, “আমার ছেলেমেয়েদের উপরে অত্যাচার হোক, তা চাই না।” এ দিন তিনি বলেন, “টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে ওই ঘেরাও হয়েছিল। মানিনি, পুলিশও ডাকিনি।”
মালবিকা সরকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন কিছু পড়ুয়া তাঁকে ঘেরাও করেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ফেলেন তিনি। পুলিশ ডাকার মতো অবস্থা হয়েছিল? প্রশ্নের উত্তরে বুধবার তিনি বলেন, “না, সেই ক্রাইসিস পয়েন্টে যেতে হয়নি। কেন দাবি মানা যাবে না, ছাত্রছাত্রীদের তা বোঝাই। ওরাও যুক্তি মেনে নিয়েছিল।” যাদবপুরের ঘটনা সম্পর্কে অবশ্য মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন মালবিকাদেবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy