মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজকুমার।
বাহিনীর অন্দরে তাঁর বদমেজাজ নিয়ে অনেকেরই বিস্তর অভিযোগ। মারকুটে স্বভাবের পরিচয় পেয়েছেন মধ্য কলকাতা, ভবানীপুর, হাজরার যানবাহন চালকরা। এ বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও টের পেলেন কম্যান্ডো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর রাজকুমার সিংহের ‘দাপট’।
প্রহৃত ও নিগৃহীত ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মারমুখী পুলিশদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন সাদা টি-শার্ট, সবুজ টুপি পরা এক জন। ছ’ফুটের উপর লম্বা, পেটানো চেহারার ওই ব্যক্তি নিজে যেমন বেশ কয়েক জন পড়ুয়াকে বেধড়ক পিটিয়েছেন, তেমনই তাঁর নির্দেশে ইউনিফর্মে থাকা পুলিশকর্মীদের সঙ্গে টি শার্ট-ট্র্যাক প্যান্ট-চটি পরা একদল লোকও পড়ুয়াদের উপরে ঝাপিয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ। ছাত্রছাত্রীরা এঁদেরই বলছেন ‘গেঞ্জি পুলিশ’। একাধিক টিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে এই বাহিনীর হিংসাত্মক চেহারা। পড়ুয়াদের অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতে ঘেরাও তুলতে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল, তাতে তাঁদের মোটেই আইনরক্ষক মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, এক দল লেঠেল হামলা চালিয়েছে, যাদের সর্দার ওই সাদা টি শার্ট-সবুজ টুপি।
কলকাতা পুলিশের একাংশই চিহ্নিত করেছেন, সাদা টি-শার্ট, সবুজ টুপি পরা ওই ব্যক্তি হলেন, কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের ইন্সপেক্টর রাজকুমার সিংহ।
লালবাজারের সূত্রের খবর, বদমেজাজি, মারকুটে অফিসার হিসেবে ‘সুনাম’ রয়েছে রাজকুমারের। এর আগেও বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। বাহিনীর অন্দরেই অভিযোগ, তিনি অল্পে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন, দুমদাম গায়ে হাত তোলেন। হেয়ার স্ট্রিট থানায় কর্মরত থাকার সময়ে হকার ও যানবাহন চালকদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে রাজকুমারের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েক জন সহকর্মীর হস্তক্ষেপে সে সব ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এমনকী ধর্মতলা চত্বরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিটিং-মিছিলের সময়ে রাজকুমার একাধিক বার অহেতুক গোলমালে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে চাকরি-জীবন শুরু করেন রাজকুমার। ১৯৯৩ সালে অফিসার নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করে সার্জেন্ট হিসেবে বাহিনীতে যোগ দেন। মার্শাল আর্ট-বক্সিংয়ে প্রশিক্ষিত রাজকুমারকে কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ নিতে ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড (এনএসজি)-তেও পাঠানো হয়। এক সময় পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পেয়েছিলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে।
এবিপি আনন্দের সৌজন্যে ও ফাইল চিত্র।
পরবর্তী সময়ে রাজকুমার ভবানীপুর থানায় সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করেন বছর চারেক। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও সার্জেন্ট পদোন্নতি পেয়ে ইন্সপেক্টর হলে তিনি আর থানায় কাজ করতে পারেন না। থানা বাদ দিয়ে বাহিনীর অন্যত্র তাঁকে বদলি করা হয়। কিন্তু লালবাজার সূত্রের খবর, ২০১৩ সালে ইন্সপেক্টর হওয়ার পরেও রাজকুমার ভবানীপুর থানায় প্রায় এক বছর থেকে গিয়েছিলেন, যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। পুলিশের একাংশের দাবি, ভবানীপুরের বাসিন্দা, তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার সুনজরে থাকার ফলেই এটি সম্ভব হয়েছিল। পরে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে হইচই হওয়ায় রাজকুমারকে কমব্যাট ব্যাটেলিয়নে সরিয়ে দেওয়া হয়। বাহিনী সূত্রেই জানা যাচ্ছে, রাজকুমারের নাকি এতটাই দাপট যে, ভবানীপুর থানায় থাকাকালীন তাঁর ফাইফরমাশ খেটে দেওয়া খিদিরপুর এলাকার এক যুবককে তিনি তদ্বির করে হোমগার্ডের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন। মাস দুয়েক আগে ওই হোমগার্ড শরৎ বসু রোডে রিভলভার নিয়ে তোলা আদায় করার অভিযোগে গ্রেফতার হন।
শুধু তা-ই নয়, পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর স্বাধীনতা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন, সে সময় একাধিক বার মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থেকে তাঁকে সহায়তা করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই রাজকুমারকে। শাসক দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাই এর কারণ বলে সূত্রটির দাবি।
এই রাজকুমারকেই মঙ্গলবার রাতে কেন গুরুদায়িত্ব দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হল, বাহিনীর অন্দরে সেই প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে পড়ুয়ারা সামিল, সে রকম স্পর্শকাতর পরিস্থিতি সামলাতে এমন অফিসারদেরই সাধারণত পাঠানো হয়, যাঁরা ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি সামাল দিতে পারবেন। উত্তেজিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও উত্তেজিত হবেন না। পুলিশের একাংশ মনে করছেন, যাদবপুরের ওই ঘেরাও-কর্মসূচিতে যে সব ছাত্রছাত্রী সামিল হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই শাসক দলের বিরোধী। কাজেই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে চিহ্নিত অফিসার রাজকুমারকে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল কি না, সেই সন্দেহও করেছেন লালবাজারের কেউ কেউ।
বুধবার অবশ্য রাজকুমার এই সব অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। “যা বলার শীর্ষ কর্তারাই বলবেন” বলেছেন তিনি।
কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার বক্তব্য, রাজকুমার যে হেতু বাহিনীরই এক জন, কাজেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যাওয়া নিয়মবিরুদ্ধ কিছু নয়। আর এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্থানীয় থানাগুলির পাশাপাশি কমব্যাট ব্যাটেলিয়ন, রিজার্ভ ফোর্স, সশস্ত্র পুলিশ থেকেই অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানো হয়। তবে কী পরিস্থিতিতে, কোন উচ্চপদস্থ কর্তার নির্দেশে রাজকুমার তাঁর বাহিনী নিয়ে ক্যাম্পাসে গেলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ-ও বলেছেন, “যদি খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের কেউ অসদুদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে বাড়াবাড়ি করেছেন, তা হলে তাঁকে রেয়াত করার প্রশ্ন নেই।” অবশ্য তিনি জানান, অনেক সময়ে পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে যায় যে, পুলিশি ব্যবস্থাকে ‘বাড়াবাড়ি’ মনে হয়। আর এক শীর্ষ কর্তা আবার অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “রাজকুমারকে না পাঠিয়েও অনেক সময়ে কোনও উপায় থাকে না। কিছু কিছু থানা এলাকায় ওর বিপুল চাহিদা। ও নাকি পরিস্থিতি সামলাতে দড়!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy