Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
mahishadal rathayatra

ঐতিহ্যে, গৌরবে আজও অমলিন মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রা

মহিষাদল রাজবাড়ির রথে, শ্রীজগন্নাথদেব আরোহণ করেন না। আরোহণ করেন মহিষাদল রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপাল জিউ।

মহিষাদলের সেই সুবিশাল রাজবাড়ি। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী

মহিষাদলের সেই সুবিশাল রাজবাড়ি। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী

শান্তনু চক্রবর্তী
মহিষাদল শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৯ ১৪:৫২
Share: Save:

ইন্টারনেট, ৪ জি-র যুগে আজও স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলার এক ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজপ্রাসাদ আর তাদের পরিবারের বিখ্যাত রথযাত্রা। কলকাতা থেকে ১২০ কিমি দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমায় ৭০ একর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল রাজমহল। তাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত রথযাত্রার কদর আজও অমলিন। রথ উপলক্ষে মেলা চলে প্রায় ২০ দিন ব্যাপী। ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে আসুন দেখে নেওয়া যাক, কী ভাবে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ী পরিবারের বাংলায় রাজপাট বিস্তারের কাহিনি।

তখন মুঘলরাজ চলছে। ষষ্ঠদশ শতকে তাঁর সেনা বিভাগের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মচারী, উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা, ব্রাহ্মণ ব্যবসায়ী জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার কাজে নদীপথে এসেছিলেন মহিষাদলের সন্নিকটে গেঁওখালিতে। নদীমাতৃক বাংলার প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়ে এখানে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। মহিষাদল এলাকার তৎকালীন রাজা কল্যাণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে মহিষাদলের নিলামি জমিদারি রাজত্ব কিনে নেন। অচিরেই জনার্দন উপাধ্যায় মহিষাদলধিপতি হন। এখান থেকেই সূত্রপাত মহিষাদল রাজপরিবারের। রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর রানি জানকী রাজত্বের দায়িত্ব নেন। এর পর তাঁর জামাতা ছক্কনপ্রসাদ গর্গের ছেলে গুরুপ্রসাদ গর্গ রাজা হন। সেই থেকে মহিষাদলে গর্গ রাজাদের রাজপাটের সূত্রপাত।

পরিবারের ক্রমানুসারে তিনটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ হয়। প্রথম রাজপ্রাসাদটি আজ অবলুপ্ত। রয়েছে রঙ্গিবসান রাজবাড়ি। নবাবি আমলের সিংহদুয়ার, যা আনুমানিক ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল। অন্যটি ফুলবাগ রাজবাড়ি যা আনুমানিক ১৯৩৪ সালে তৈরি হয়। তা ছাড়াও রাজবাড়ি চত্বরে গোপাল জিউর মন্দির ও রামবাগে রামজিউর মন্দির রয়েছে। বর্গিদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজপ্রাসাদের চারপাশে কাটা হয়েছিল সুগভীর পরিখা। তবে সংস্কারের অভাবে তা আজ প্রায় লুপ্ত। ধর্মপ্রাণ রানি ও গর্গ পরিবার মহিষাদল ঘিরে নানা মন্দিরের স্থাপনা করেন।

আরও পড়ুন : কাশ্মীর: লাল জন্নত, গুজ্জর বিক্রম

রানি জানকী দেবীর বিশেষ উত্‍সাহে মহিষাদলে রথযাত্রা শুরু হয় ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে, রানি এক দিন স্বপ্নাদেশ পান, নদীর জলে ভেসে আসছে শালগ্রাম শীলা। তাকে কুলদেবতার আসনে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রানি জানকী দেবী মহিষাদল রাজবাড়ির ঠিক সামনেই প্রায় ১০০ ফুট উচ্চতার মন্দির তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন রাজপরিবারের কুলদেবতা মদনগোপাল জিউকে। জনশ্রুতি বলছে, এক দিন একদল প্রজা এসে রানি জানকীর কাছে আবেদন জানান, শ্রীক্ষেত্র পুরীর মতো মহিষাদলেও রথযাত্রা চালু করা হোক। প্রজাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে মহিষাদলে চালু হল রথযাত্রা। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রানি জানকি দেবী মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রার প্রচলন করেন। শুধুমাত্র মেদিনীপুর নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের যে ক’টি বিখ্যাত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত রথযাত্রা রয়েছে, মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রা তার অন্যতম।

মহিষাদল রাজবাড়ির রথে, শ্রীজগন্নাথদেব আরোহণ করেন না। আরোহণ করেন মহিষাদল রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপাল জিউ। ঠিক যেমন ভাবে, অধুনা বাংলাদেশের ধামরাইয়ের রথে আরোহণ করেন, যশোমাধব। আবার পুরী, বারিপদা বা মাহেশের রথের অধিপতি শ্রীজগন্নাথ।

মহিষাদল রথযাত্রার প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে।ছবি: নিজস্ব চিত্র

রানি জানকিদেবীর আমলের রথ ছিল ২০ চুড়োর। বিপুল জাঁকজমক আর আড়ম্বরে তা পালন করা হত। দেশদেশান্তর থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম হত। উৎসব আর মেলা চলত প্রায় এক মাস ব্যাপী। এখন আড়াশো বছর আগের সেই আড়ম্বর এখন আর নেই। রথের মেলার প্রকৃতিও বদলে গিয়েছে আমূল। তবু মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রার ঐতিহ্য আজও অমলিন। মে মাস থেকে শুরু হয়েছে রথ সংস্কারের কাজ। ১৩ চূড়াবিশিষ্ট কাঠের রথে ৩৪টি চাকা। ১৮৫১ সালে লক্ষ্মণপ্রসাদ গর্গ এই রথটি তৈরি করেন। একসময় রাজবাড়ির নিজস্ব হাতি ছিল। তার পিঠে বসে লাল নিশান দেখিয়ে পথ নির্দেশ করতেন মাহুত। পালকি চড়ে আসতেন রাজবাড়ির সদস্যরা, কামান দেগে সূচনা হত রথযাত্রার। আবার উল্টোরথে গুণ্ডিচাবাড়ি থেকে বিগ্রহ ফিরে এলেও কামান দাগা হত।

তবে রাজা, রাজত্ব, রাজপাট লুপ্ত হলেও ঐতিহ্য মেনে রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ পালকি চড়ে রাজবাড়ি থেকে রথের সামনে যান। সঙ্গে সঙ্গে চলে রাজছত্র, রাজাবাহাদুরের দেহরক্ষী। পালকি থেকে নামার আগেই ডঙ্কা বাজিয়ে জানান দেওয়া হয় রাজাবাহাদুরের আগমন। তিনিই পালন করেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। তার পর টান দেন রথের রশিতে।

মহিষাদল রাজবাড়ির রথে জগন্নাথের সঙ্গী বলরাম সুভদ্রা নন, গোপাল জিউ ও রাজ রাজেশ্বরী। তার পর বিশাল রথের দুধারে হাজারো মানুষের সমাগমে রথের দড়িতে টান পড়ে। এগিয়ে চলে মহিষাদলের রথ। আর রথের পুণ্যতিথির দিন থেকেই কাঠামোয় মাটি দেওয়ার কাজ শুরু হয়। শুরু হয়ে যায় বাঙালির আরও এক প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজার প্রস্তুতি।

ইচ্ছে হলেই মহিষাদল রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখে নিতে পারেন। ফুলবাগ রাজপ্রাসাদের এক তলায় রাজপরিবারের পক্ষ থেকে সংগ্রহশালা করা হয়েছে। ২০১২-র ৩০ জুলাই এই সংগ্রহশালা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। রাজপ্রাসাদের পাঁচটি ঘরে সযত্নে রাখা রয়েছে রাজপরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, চিঠিপত্র, তৈলচিত্র, নানা ছবি। অন্য ঘরে ঢাল, তরবারি থেকে শুরু করে রাজসেনাদের নানা অস্ত্র, পোশাক রাখা হয়েছে। প্রতি দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য মাত্র ১০ টাকা।

প্রয়োজনীয় তথ্য: কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে গেলে, ডায়মন্ড হারবারের কয়েক কিলোমিটার আগে সরিষা। সরিষা থেকে যেতে হবে নূরপুর, যা বর্তমানে রায়চক নামে খ্যাত। এই রায়চক বা নূরপুর থেকে গঙ্গা পার হয়ে গেঁওখালি। গেঁওখালি থেকে মহিষাদল।

হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে মেচেদা স্টেশন। মেচেদা থেকে হলদিয়াগামী বাসে চড়তে হবে, ভায়া তমলুক। পথে পড়বে মহিষাদল বাজার। মহিষাদল বাজারে নেমে ডান দিকে গেলে মহিষাদল রাজবাড়ি। আবার কলকাতা থেকে সরাসরি বাসেও মহিষাদল যাওয়া যেতে পারে। দূরত্ব ১২০ কিমি।

আরও পড়ুন : অসমের পবিতোরার জঙ্গলে

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy