পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলবে চিলিকা হ্রদে।—ফাইল চিত্র।
পুরী যাঁরা বেড়াতে গেছেন তাঁরা অনেকেই চিলিকা হ্রদেও বেড়াতে গেছেন। এটা নতুন নয়। কিন্তু এশিয়ার বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ চিলিকার বুকে মিশে আছে। তার একটির নাম রম্ভা। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপভূমি। সুন্দর সব নাম তাদের। হানিমুন দ্বীপ, ব্রেকফাস্ট, নলবন, কালিঘাই, সোমোলো, বার্ডস আইল্যান্ড। আর হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে,এখানেই নানান পরিযায়ী পাখি সাইবেরিয়া, ইরান, মধ্য এশিয়া থেকে ছুটে আসে।
পাখি দেখতে আপনিও আসতে পারেন। ওড়িশার গঞ্জাম জেলার ছোট্ট জনপদে পান্থনিবাসের কটেজে থাকাই ভাল। সরকারি বোট ভাড়া করে ভেসে পড়ুন। নানান ছোট ছোট দ্বীপ আর জলসীমানায় অপরূপ দৃশ্যাবলীর কোলাজ মুগ্ধ করবে। বেকন, বড়াকুরা, সমোলো, হানিমুন, ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড এবং বিমলাদেবী মন্দির, নারায়ণী ঝর্না দেখে নিন। ওড়িশার হ্রদ ছোঁয়া রম্ভা মন ছুঁয়ে যায়।
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ১২৮২১ ফলকনামা এক্সপ্রেস। ১৮৬৪৫ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস। ১২৮৪১ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ১২৮৩৯ চেন্নাই মেল। নামতে হবে বালুগাঁও। এখান থেকে ২৬ কিমি দূরে রম্ভা। গাড়িতে কম-বেশি ৮০০ টাকা ভাড়া।
চিলিকা হ্রদ।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: গোপালপুর-চাঁদিপুর-তপ্তপানি
বরকুল
ওড়িশার আর এক হ্রদ ছুঁয়ে থাকা শহর খুরদা জেলার বরকুল। বিশাল চিল্কা তার বহতায় যুক্ত করেছে তিন জেলাকে, তিনটি পৃথক নামে। গঞ্জামে, রম্ভা। খুরদায়, বরকুল। পুরীতে, সাতপাড়া। বরকুলের আকাশের পুবপ্রান্তে অসাধারণ সূর্যোদয়ের মায়ায় মেতে ওঠে লেক মহল্লা। বিশাল হ্রদের বুকে নানা রঙের হাজারো জেলে নৌকা ভেসে বেড়ায় মাছের সন্ধানে। মাছলোভা পাখিরাও ভিড় জমায় নীল আকাশের ক্যানভাসে। বোটে চড়ে ভেসে পরুন, আশ্চর্য জলদুনিয়ায়। মাছলোভা পাখিদের সঙ্গে আপনিও সামিল হোন। এখানেও নানা দ্বীপ দর্শন করা যায়। বরকুলের পান্থনিবাসে থাকাই ভাল। এখান থেকেই সরকারি বোট ভাড়া করে নিন। নির্ধারিত রেট। ঠকবার ভয় নেই। অসাধারন রূপশোভায় ভরপুর জলভ্রমণের শেষে সূর্যাস্তের মায়াবী ডুবের ছবি চিরকাল মনে থেকে যায়।
কী ভাবে যাবেন
রম্ভা থেকে বরকুলের দূরত্ব ২০ কিমি। গাড়িতে চলে আসা যায়।
ভিতরকণিকা
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ। সুন্দরবনের মতোই, বৈচিত্রময় ওড়িশার জল-ম্যানগ্রোভ মেশা রোমাঞ্চকর জঙ্গলমহল। ১৯৯৮ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। বিশ্বের ৭২ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের মধ্যে ৬২ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের দেখা মেলে ওড়িশার ৬৭২ বর্গকিমির ভিতরকণিকায়। চাঁদবালি থেকে ডাংমল আসার রোমাঞ্চকর নদী পথটি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে নানা বন্যপ্রাণ দেখার স্বর্গরাজ্য। লঞ্চের ডেকে বসেই হরিণ, বন্য শুয়োর, সম্বর, পাখি-সহ প্রচুর কুমিরের দেখা মেলে। ডাংমলে থাকার জন্য রয়েছে বনবাংলো। এখানেও নানা বন্যপ্রাণের দেখা মেলে।ডাংমলে কুমির প্রকল্প। কুমির প্রজননের পর নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
লঞ্চ থেকেই দেখা মিলবে কুমিরের। ছবি: প্রবীর চক্রবর্তী।
এখানকার সুন্দর মিউজিয়ামটি দেখতে ভুলবেন না। রাতে বনবাংলো থেকে বাইরে বের হবেন না। ডাংমল থেকে আরও এক রোমাঞ্চকর জলযাত্রায় চলে আসা যায় চার কিমি দূরের গহিরমাথায়। লঞ্চ থেকে নেমে জঙ্গলের বুকচেরা পথ বেয়ে চলে আসুন গহিরমাথা সাগরপাড়ে। নির্জন সাগরপাড় আর সোনালী বালুকাবেলা। এখানেই বিরল প্রজাতির অলিভ রিডলে-রা সুদূর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল পাড়ি দিয়ে ডিম পাড়তে আসে। গহিরমাথা সাগরপাড় হল অলিভ রিডলেদের নিশ্চিন্ত আবাসভূমি।ডিসেম্বর-মার্চের মধ্যে ডিম পাড়তে আসে ওরা। এই সময় ওদের যাত্রাপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ডাংমল থেকে লঞ্চে ঘুরে আসতে পারেন, হাভালিকোঠী, একাকুলা গুপ্তি থেকে।
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ১২৮২১ ফলকনামা এক্সপ্রেস। ১৮৬৪৫ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস। ১২৮২১ ধৌলি এক্সপ্রেস। ১৮৪০৯ জগন্নাথ এক্সপ্রেস। নামতে হবে ভদ্রক। গাড়িতে চলে আসুন চাঁদবালি, দূরত্ব ৫৫ কিমি। চাঁদবালি থেকে লঞ্চে যেতে হবে ভিতরকনিকা।
সিমলিপাল জঙ্গলে মিলতে পারে বাঘের দেখাও।—ফাইল চিত্র।
সিমলিপাল
ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার এক অসাধারণ জঙ্গলমহল। শালের গহন বনে দেখা মেলে নানা বন্যপ্রাণের। এই জঙ্গলের বহুমাত্রিক প্রকৃতির বুকে পাহাড় কোথাও ন্যাড়া, কোথাও সবুজ, কোথাও বিস্তীর্ণ ঘাসজমিনের বিস্তার। গহিন জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে খৈরী, সারাণ্ডি, পলপলা নদী। জঙ্গল ঘিরে রেখেছে সুউচ্চ খৈরীবুরু ও মেঘাসানি পাহাড়। এই নিয়েই ওড়িশার সিমলিপাল।জঙ্গলের প্রান্তে অপরূপ প্রাকৃতিক নিস্বর্গে ভরপুর দুই প্রপাত। বরেহিপানি ও জোরান্ডা জলপ্রপাত দেখে বুঁদ হয়ে থাকুন। রয়েছে চাহালার নজরমিনার। ১ নভেম্বর ১৫ জুন পর্যন্ত খোলা থাকে, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জঙ্গল বেড়ানোর অনুমতি মেলে। কপাল ভাল থাকলে ময়ূর, হরিণ, গাউর, হাতি, শম্বর, বিষধর সাপ, নানা প্রজাতির পাখি এবং বাঘের দেখা মিলতে পারে। নানা বৃক্ষবৈচিত্রের সম্ভারে অনন্য সিমলিপাল।
কী ভাবে যাবেন
১২৮২১ ধৌলি এক্সপ্রেসে নামুন ভদ্রক। গাড়িতে বালেশ্বর হয়ে চলে আসুন সিমলিপালের প্রবেশদ্বারে। জঙ্গল খোলা থাকে ১ নভেম্বর থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত।
কুলডিহা
চাঁদিপুর থেকে মাত্র ৪৫ কিমি দূরে ২৭২.৭৫ বর্গকিমির এক অসাধারণ জঙ্গলমহল। অনন্য অরণ্যভূমিকে ১৯৮৪ সালে অভয়ারণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চিতাবাঘ, হরিণ, পাইথন, শম্বর, হাতি, ভাল্লুক নিয়েই ওড়িশার কুলডিহা অভয়ারণ্য। প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে হয়। রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে শাল-মহুয়ার পাশাপাশি ২৯০ প্রজাতির বৃক্ষবৈচিত্রে ভরপুর জঙ্গলমহল কুলডিহা অনন্য। কপালগুণে যদি পূর্ণিমা পাওয়া যায়, তা হলে সোনায় সোহাগা। কুলডিহা থেকে ৯ কিমি দূরের জোয়াচূড়ার বনবাংলো। চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্নায় ভেজা জোয়াচূড়া বনবাংলো। জঙ্গল থেকে ভেসে আসা নানা পশুপাখির আওয়াজে বনমহল্লায় রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা স্মৃতির গভীরে থেকে যায়।
কী ভাবে যাবেন
নামতে হবে বালেশ্বরে। সবচেয়ে ভাল ট্রেন ১২০৭৩ জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। গাড়ি বুকিং করে চলে আসাই ভাল। বনবাংলোয় থাকলে রেশন অবশ্যই সঙ্গে আনবেন।
দেবরীগড় অরণ্য। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী।
দেবরীগড় অভয়ারণ্য
ওড়িশার অল্পচেনা অরণ্যভূমি। সম্বলপুর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে চলে আসুন দেবরীগড় অভয়ারণ্য। আসার আগে অবশ্যই সম্বলপুরের বিখ্যাত সামলেশ্বরী মন্দিরটি দেখে নিন। মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন দেবী ত্রিনয়নী দুর্গা। এর পর মহানদীর উপর বিখ্যাত হীরাকুদ বাঁধ পেরিয়ে চলে আসুন ৩৪৭ বর্গকিমির শুষ্ক, পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গলমহলে। ভাল্লুক, নানা প্রজাতির হরিণ, নীলগাই,লেপার্ড-সহ ঝিলের ধারে কুমিরের দেখা মেলে। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বনবাংলো।
কী ভাবে যাবেন
১২৫৮৫ হাওড়া-সম্বলপুর সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। প্রতি শনিবার ২০.৫৫ মিনিটে ছেড়ে পর দিন সকাল ৮-১০ মিনিটে। ১২৮৭১ ইস্পাত এক্সপ্রেস, ১৮০০৫ হাওড়া কোরাপুট এক্সপ্রেস চলে আসুন সম্বলপুর। এখান থেকে গাড়িতে ৫০ কিমি দূরেই দেবরীগড় অরণ্য।
মহনদীতে জলপান করতে আসে বন্যপ্রাণীরা। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী।
সাতকোশিয়া
ওড়িশার অল্পচেনা ঘনসবুজ পাহাড়ি গর্জের মধ্য দিয়ে সাত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাই এই জায়গার নাম সাতকোশিয়া। ৮০০ বর্গকিমির ওড়িশার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঘ্র প্রকল্প। মহানদীর চরে ঘনসবুজ অরণ্যমহল আর আকাশের সীমান্তে পাহাড়ের ঘেরাটোপে পাখির কুজনে ভরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সাতকোশিয়া। নদীর পাড়ে পৌঁছতেই চোখে পড়বে নানান রঙের বিলাসী তাঁবু। টিকড়পাড়া নেচার ক্যাম্প। সামনেই মহানদীর চর। আর সেখানেই নানান বন্যপ্রাণী আসে জলপান করতে। কুমির, ঘড়িয়ালের দল অলস ভাবে রোদ পোহায়। মাঝে মাঝে অবাক চোখে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের তাঁবুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। চারপাশের জঙ্গল জুড়ে হাতি, গাউর, লেপার্ড, ভালুক, হরিণ, বাঘেদের অবাধ বিচরণক্ষে। গাইড সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।লবঙ্গির জঙ্গল, পুরানাকোঠীর নজরমিনার। সকালের কুয়াশামাখা সাতকোশিয়া রোমান্টিকতায় অদ্বিতীয়।
আরও পড়ুন: চিরচেনা পুরী-সাতপাড়া-কোনারক
কী ভাবে যাবেন
নামতে হবে কটক। হাওড়া থেকে ১২৮২১ ফলকনামা এক্সপ্রেস। ১৮৬৪৫ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস। ১২৮২১ ধৌলি এক্সপ্রেস। ১৮৪০৯ জগন্নাথ এক্সপ্রেস। গাড়িতে চলে আসতে হবে। ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
রম্ভা: ওটিডিসি-র পান্থনিবাস (০৬৮১০-২৭৮৩৪৬) ভাড়া ৮৫০-২৯৫০ টাকা।
বরকুল: ওটিডিসি-র পান্থনিবাস (০৬৭৫৬-২৫৭৪৮৮/২৫৭৩৮৮) ভাড়া ৯৫০-২৫০০ টাকা।
ভিতরকণিকা: ওটিডিসি-র পান্থনিবাস চাঁদবালিতে (০৬৭৮৬-২২০৩৯৭) ভাড়া ৭৫০-১৫৫০ টাকা। ডাংমলে (০৯৪৩৭২-৮৫১০৪) ভাড়া ১০৫০-১৮৫০ টাকা।
সিমলিপাল: ওটিডিসি-র পান্থনিবাস। অনলাইন বুকিং করতে পারেন। www.otdc.in
কুলডিহা: জুয়াচুয়া ও কুলডিহা বনবাংলোতে থাকা যায়। যোগাযোগ করতে পারেন (০৬৭৮২-২৫৬১৪২)।
সাতকোশিয়া: রয়েছে নেচার ক্যাম্প। বুকিং www.satkosia.org
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy