ভারডিটার ফ্লাইক্যাচার, রুফাস সিবিয়া এবং চেস্টনাট টেলড স্টার্লিং (বাঁ-দিক থেকে)।
মার্চ মাসের কথা। ক’দিন পেরোলেই ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমা, বসন্ত উৎসব। হাতে চার দিনের ছুটি, প্রাণে সবুজ পাহাড়ের টান অনুভব করলাম। তখন অজানা এক ভাইরাসের আতঙ্কের খবরে মনটা ভীত সন্ত্রস্ত। আমাদের দেশও আক্রান্ত হতে আর দেরি নেই— এমন সতর্কবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ভাবলাম, আগামী দিনে বুঝি ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে! তাই এই ফাঁকে ঘুরে আসি পাহাড়ের কোলে শান্ত পরিবেশে, যেখানে পাখিরা গান শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখে। বলে রাখি আমার নেশা ছবি তোলা। তাই দেরি না করে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে পাখির দেশে পাড়ি দিলাম। গন্তব্য, মহানন্দা ও তিস্তা নদীর মাঝে, হিমালয়ের পাদদেশে মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। সবুজ ঘন জঙ্গল আর তার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পাকদণ্ডী।
কলকাতা থেকে বিমানে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। সেখান থেকে গাড়িতে ৪২০০ ফুট পাহাড়ের উচ্চতার একটি গ্রাম লাটপাঞ্চার। দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার আর সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা। কালিঝোরা থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটারের পথ।
রুটম্যাপ
• কী ভাবে যাবেন: বিমানে শিলিগুড়ি অথবা ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়িতে লাটপাঞ্চার
• উপযুক্ত সময়: অক্টোবর থেকে মে
রাস্তায় যাঁরা নিয়মিত পাখির খোঁজে ঘোরাঘুরি করেন বা ফোটোগ্রাফি করেন, তাঁদের কাছে ছোট্ট গ্রামটি অজানা নয়। গ্রামটির জঙ্গলের আনাচকানাচে বেশ কিছু পশু ঘোরে। আর আছে প্রায় ২৪০ রকম প্রজাতির পাখি। জায়গাটির নামডাকের কারণ, রুফাস নেকড হর্নবিল। ‘রুফাস’ শব্দের অর্থ লাল ও খয়েরি রঙের মিশ্রণ। হ্যাঁ, এ রকমই এক অদ্ভুত রঙের পাখি আর তার বিচিত্র ঠোঁটটি। পাখিটি বিলুপ্তির পথে।
মনে বেশ আশা নিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যাস্তের পালা। মার্চের মাঝামাঝিও বেশ শীত। উঠলাম পাহাড়ের কোলে সুন্দর হোমস্টে’তে। সামনে হিমালয় আর হাতে ধূমায়িত দার্জিলিং চায়ের পেয়ালা।
বহমান: তিস্তাপারের বৃত্তান্ত
পথে আসার সময় বেশ কিছু পাখির দেখা মিলল। পাহাড়ি বুলবুল, হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট ও আরও অনেকের... পর দিন ভোর পাঁচটায়, সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা নিয়ে গাইডের সঙ্গে। স্থানীয়দের অনেকেই জানেন, কোথায় কখন কোন পাখি দেখার সম্ভাবনা আছে। তাই তাঁদের সাহায্য নেওয়াই ভাল। মনে বেশ উত্তেজনা। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে নীচে নামতে শুরু করলাম। গাছের আনাচকানাচে নানা রঙের পাখি। নিঃশব্দে আড়াল থেকে ক্যামেরাবন্দি করতে থাকলাম তাদের। খালি চোখে দূর থেকে সবই যেন ধূসর! কিন্ত যে মুহূর্তে ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখছি, চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তাদের বাহারে। শ্যাওলাভেজা পথে নানা রঙের নাম না জানা পাহাড়ি ফুলের মধ্য দিয়ে হেঁটে ও খানিকটা পথ গাড়ি করে ঘুরে বেশ কিছু পাখির দেখা মিলল। আরও অনেকেই চুপিচুপি পাখিদের ছবি তুলছেন। প্রচুর বাঙালি ও অবাঙালি মানুষ পাখির খোঁজে এসেছেন। বেশ আশ্চর্য না? অথচ অনেকেই টুরিস্ট স্পট হিসেব এই জায়গাটার নামই জানেন না। ভিড় নেই বলে জায়গাটি বেশি উপভোগ্য। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ মনকে আরাম দেয়। এই ছোট্ট ঘুমন্ত গ্রামটি পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ।
আর একটি কারণে গ্রামের খুব নামডাক। ম্যালেরিয়া ও অন্য কয়েক ধরনের জ্বরের ওষুধের উৎস সিঙ্কোনা। প্রাচীন কালে পেরুতে আন্দিজ় পাহাড়ের কোলে ঠান্ডার কাঁপুনি থেকে বাঁচতে সেখানকার বাসিন্দারা এই গাছের চাষ করতেন বলে শোনা যায়। সিঙ্কোনার ছাল থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩০টি চিহ্নিত রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে কুইনাইন সর্বোত্তম। মংপুতে ১৮৬৪ সালে ডক্টর টমাস অ্যান্ডারসনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এই গাছের চাষ। তার পর ১৯৪৩ সাল থেকে লাটপাঞ্চারের পাহাড়ের গায়েও শুরু হয় এই গাছের চাষ। এই চাষই স্থানীয়দের জীবিকা।
দু’দিন লাগাতার রংচঙে পাখিদের খোঁজে পাহাড় ভেঙে ঘুরতে কোনও কষ্টই হল না। এমনই এখানকার জলবায়ুর গুণ। হর্নবিল না এলেও, অন্য অনেক পাখি ধরা পড়ল আমার ক্যামেরায়। এল রুফাস সিবিয়া, মিনিভেট, নানা রঙের সানবার্ড, ব্লু থ্রোটেড বারবেট, চেস্টনাট বেলিড রক থ্রাশ, সুলতান টিট, মিসেস গুল্ড’স সানবার্ড ও আরও অনেকে। এই করোনার তাণ্ডব কমলে, প্রকৃতিপ্রেমীরা অবশ্যই ঘুরে আসুন লাটপাঞ্চার। ঠান্ডায় গেলেই ভাল। পাহাড়ি জায়গায় আগুনের পাশে বসে গরম দার্জিলিং চায়ের আমেজটাই আলাদা লাগে।
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy