বিস্ময়ে তাই জাগে: প্রকৃতির কোলে
মনমেজাজ খারাপ। তখন সদ্য ভেস্তে গিয়েছে একটা বহু কাঙ্ক্ষিত ট্রিপ। অন্যমনস্ক হয়েই সাইকেলের মুখ ঘুরিয়েছিলাম নর্থ-ইস্টের দিকে। মেঘালয়ের রিওয়াই গ্রামে থামার পরে মনে হয়েছিল, এখানে ক’টা দিন থেকে গেলেই হয়। কাছেই মওলিনং, দুনিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম। রিওয়াই কেন পিছিয়ে থাকবে,
এমন ভাবনা আসতেই নড়ে উঠল মাথার পোকা। স্থানীয় স্কুলের বাচ্চাদের নিয়েই কাজে লেগে পড়লাম। প্লাস্টিক বর্জনের উপায়, রিসাইকল করার পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে খানিক জ্ঞানও দিলাম ওদের। পরে মনে হল, সত্যিই কি কাজের কাজ করতে পারব ওদের জন্য? কয়েকজন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিলাম তত দিনে। তাদের বললাম আমার প্ল্যান। পাহাড়কে প্লাস্টিক মুক্ত করা, একটি স্কুল তৈরি করা আর সেখানকার বাচ্চারা যাতে ফুটবল খেলতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। স্বপ্নতো অনেক, কিন্তু তা পূরণ করতে চাই টাকা। করিমপুর অর্থাৎ নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম একরাশ ভাবনা নিয়ে। পুজোর পর থেকে শুরু করে দিলাম তোড়জোড়। মিশন ‘কেটুকে’!
অন্তহীন: বেঙ্গালুরুর পথে
কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর সাইকেলে এর আগেও হয়তো অনেকেই গিয়েছেন। তবে আমায় সবচেয়ে বেশি তাড়া করেছে ফান্ড রেজ়িংয়ের চিন্তা। ডিরেক্ট ফান্ডিং, ক্রাউড ফান্ডিং... বিভিন্ন পন্থায় টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি চলার পথেই। ট্রান্স-হিমালয়ান ট্রিপের সঙ্গী আমার সাইকেলটিকে ছেড়ে এসেছিলাম মেঘালয়ের কোলেই। অর্থাৎ নিজের সাইকেলও সঙ্গে নেই এ বার। তামিলনাড়ুতে পৌঁছে এক বন্ধুকে বললাম,একটা সাধারণ সাইকেল জোগাড় করে দিতে। ২৯ নভেম্বর কন্যাকুমারী থেকে যাত্রা শুরু করলাম সেই সাইকেলে। যা এর আগে কখনও চালাইনি। জানি, সময়-পরিশ্রম-ধৈর্য সবটাই অনেক বেশি লাগবে, তাও এগিয়ে পড়লাম।ট্রান্স-হিমালয়ান ট্রিপের সাইক্লিংয়ের অভিজ্ঞতা বলে, দু’চাকায় দেশ ঘুরতে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার, তা হল মনের জোর। ফিটনেস তো রয়েছেই, তবে মনের জোর হারিয়ে ফেললে লক্ষ্যে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর মনের জোর বারবার ধাক্কা খেয়েছে এবারের ট্রিপের প্রথম থেকেই। একে বৃষ্টি, তায় পুরো দক্ষিণ ভারতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এমনিতে পেট্রোল পাম্প, ধাবা কিংবা মন্দির চত্বরে থাকতেই আমি অভ্যস্ত। কিন্তু পুণে পেরোনোর আগে পর্যন্ত মন্দিরে থাকার সুযোগ হয়নি সে ভাবে।দু’-একটি নর্থ ইন্ডিয়ান ধাবা ছাড়া বাকি জায়গাগুলোয় অনুমতি মেলেনি। ভাষার অসুবিধের জন্য বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালানোও বিস্তর ঝামেলা। সাধারণত রাতে আমি চালাইনা, খুব বিপদে না পড়লে। বেঙ্গালুরু পেরোনোর দু’-তিন তখন ওপরের স্টপে পৌঁছতে পারিনি। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি, অন্ধকারে রাস্তা দেখতে পাচ্ছিনা। এমন সময়ে একটা ছাউনি দেখতে পেয়েই দৌড়ে ঢুকে পড়লাম। ক্লান্ত হয়ে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছি। সকাল হতে দেখি, ওটা একটা কবরস্থান! পুরো দেড় মাসের যাত্রাপথে ১৫-১৬ দিন তাঁবু খাটিয়ে থেকেছি। ধাবায় রাত কাটানোরও সুবিধে রয়েছে। খাওয়ার জায়গা আর পরিচ্ছন্ন টয়লেট নাগালের মধ্যেই পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু শহরে কাউচ সার্ফিং অ্যাপ থেকে হোস্টও জোগাড় করে ফেলেছিলাম। দামাল হাওয়ায় টেন্ট খাটাতে অসুবিধে হয়েছিল রাজস্থানে। তবে সারা রাস্তায় একবারও টায়ার পাংচার হয়নি, এইরক্ষে!
বেশির ভাগ জায়গাতেই শহরগুলো এড়িয়ে বাইরের রিংরোড ধরে চালাতাম ট্র্যাফিক, পলিউশন যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে। শেষ ক’দিনের রাস্তাটুকু পেরোনোর সময়ে মনের সব জোর জড়ো করে ফেলেছিলাম। তখন জানুয়ারির হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। কাশ্মীরে ঢুকতেই ইন্টারনেট চলে গিয়েছিল। মোবাইল না থাকলে কতটা লাগে, বুঝেছিলাম সে দিন।ঠিক করলাম, এরপরে হ্যান্ডম্যাপ ছাড়া কোথাও যাবনা। সারা ট্রিপে সুবিধের চেয়ে হয়তো অসুবিধেরই মুখোমুখি হয়েছি বেশি। থর মরুভূমি পেরোনোর সময়ে জলের কষ্ট কী, বুঝেছি। আমি যে কষ্ট কয়েক ঘণ্টার জন্য পেয়েছিলাম, সেটা ওখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। যে পরিবারের অতিথি হয়েছিলাম সেখানে, তাদের আমার ইউকেলেলেটা দিয়ে এসেছি। বাজনাটা হাতে ধরে ওঁদের আনন্দ আর বিস্ময় মাখানো চোখ আমার এই ট্রিপের সেরা প্রাপ্তি।
পোখরানের পারমাণবিক পরীক্ষার জায়গাটায় যাব ঠিক করে নিয়েছিলাম প্রথম থেকেই। ওখানে পৌঁছে জানলাম, যাওয়ার অনুমতি নেই। হঠাৎ দেখি, আর্মি বোঝাই একটি ট্রাক যাচ্ছে। আমি কন্যাকুমারী থেকে সাইকেলে আসছি শুনে ওঁরাই ডেকে নিলেন ট্রাকের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখে এসেছিলাম সেই খন্ডহর। দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলতে চলতে রাস্তার দু’পাশের নিসর্গ, গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষজন... দৃশ্যপট বদলে যেতে দেখার এই অভিজ্ঞতা সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে রয়ে যাবে।
১৩ জানুয়ারি উধমপুরে শেষ হয়েছিল আমার ‘কেটুকে’ ট্রিপ। যা লক্ষ্য ছিল, তার এক তৃতীয়াংশ অর্থ জোগাড় হয়েছে এ যাত্রায়। ফুটবলের কিছু সরঞ্জাম নিয়ে শিগগিরই মেঘালয়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন দেখার শুরুটা যখন হয়েই গিয়েছে, তখন ঠিক পূরণও হয়ে যাবে একদিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy