নিজেকে বদলে ফেলে আইপিএলে আলোচনার কেন্দ্রে রাহানে। ছবি: আইপিএল।
গত বছর আইপিএলে নতুন রূপে দেখা গিয়েছিল দীনেশ কার্তিককে। এ বার অচেনা মেজাজে দেখা যাচ্ছে অজিঙ্ক রাহানেকে। ক্রিকেট দর্শন বদলে ফেলেছেন মুম্বইকর। বদলে গিয়েছে তাঁর খেলা। এই রাহানে অচেনা। বিধ্বংসী। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বারুদ ঠাসা! কোথায় পেলেন এত বারুদ?
ভারতীয় দলের অধিনায়ক থাকার সময় মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, এক দিনের ক্রিকেটে ব্যাটার রাহানের সীমাবদ্ধতায় খুশি ছিলেন না। সেই ধোনি চেন্নাই সুপার কিংসেরও অধিনায়ক। আইপিএলে এখন তাঁর বড় ভরসা সেই রাহানে। নিলামের শেষে পড়ে থাকা রাহানেকে চেন্নাই নিয়েছিল ব্যাটিং বিপর্যয় রোখার জন্য। অথচ ২২ গজে বল পড়তে দিচ্ছেন না রাহানে! গত বছর ছিলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সে। শাহরুখ খানের দলের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ভরসা রাখতে পারেননি ৩৪ বছরের ক্রিকেটারের উপর।
সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য ভরসা রাখতে পারেননি জাতীয় নির্বাচকরাও। দেশের হয়ে রাহানে শেষ এক দিনের ম্যাচ খেলেছেন ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ২০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। শেষ বার দেশের হয়ে খেলেছিলেন ২০১৬ সালের অগস্টে। শুধু সাদা বলের ক্রিকেট নয়, ভারতীয় দল লাল বলের ক্রিকেটেও আস্থা হারিয়েছে রাহানের উপর থেকে। টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছেন খারাপ ছন্দের জন্য। কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও তাঁকে বাদ দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা।
অনেকেই মনে করেছিলেন রাহানের ক্রিকেটজীবন শেষ। সেই শেষ থেকেই শুরু করেছেন মুম্বইকর। আইপিএলে চার মারার নিরিখে রাহানে এখন আট নম্বরে। ৪৪৯টি চার মেরেছেন তিনি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি। ২০১২ সালের আইপিএলে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৭৩টি চার। কোনও এক বছরে চার মারার নিরিখে রাহানে আছেন সপ্তম স্থানে। টেস্ট ক্রিকেটে ধ্রুপদি ব্যাটিং করতে দেখা যায় রাহানেকে। টেকনিকের সঙ্গে কখনও সমঝোতা করেন না। সেই রাহানেই বাধ্য করছেন তাঁর ক্রিকেটকে নতুন করে কাটাছেঁড়া করতে।
ভারতীয় দলের কোচ থাকার সময় গ্রেগ চ্যাপেল ‘নেক্সট লেভেল’ ক্রিকেটের কথা বলতেন। রাহানের ব্যাটিং এখন সেই ‘নেক্সট লেভেলে’ পৌঁছেছে। এত বছরের চেনা রাহানে এবং এ বারের আইপিএলের রাহানেকে মেলাতে পারছেন না ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরাও। বিস্ফারিত চোখে দেখছেন রাহানের ব্যাটিং তান্ডব। প্রতি ৯.৫৪ টি বলে একটি করে ছক্কা মারছেন। এর আগে তাঁর সেরা ছিল ২০১৯ সালে। সে বার প্রতি ৩১.৬৭টি বলে একটি ছয় মেরেছিলেন। এ বার রাহানে এখনও পর্যন্ত প্রতি ৩.৬টি বলে একটি চার মেরেছেন। এই হিসাবে তিনিই সেরা। স্ট্রাইট রেট ২৫৪.১৬!
রবিবার ইডেনে ২৯ বলে ৭১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন রাহানে। মেরেছেন ৬টি চার এবং পাঁচটি ছয়। ধোনির জন্য সেজে থাকা ইডেনের হলুদ গ্যালারি তাঁর জন্য নেচেছে। কলকাতার বোলাররা চোখে সর্ষে ফুল দেখেছেন। অথচ রাহানের যত আগ্রাসন, সব লেখা তাঁর উইলোর চ্যালা কাঠে। খেলার শেষে জানিয়েছেন এমন আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের রহস্য। প্রাক্তন নাইট বলেছেন, ‘‘ছোট আউটফিল্ড। উইকেটের এক দিক সত্যিই বেশ ছোট।’’ ২০১৬ সালের পর আইপিএলে আবার ম্যাচের সেরা ক্রিকেটের পুরস্কার পয়েছেন।
২০২০ থেকে ২০২২ — এই তিন বছরে আইপিএলে রাহানের স্ট্রাইট রেট ছিল ১২৭.০৮। সেই রাহানের সঙ্গে এ বার কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চেন্নাইয়ের মাঠে নামলেই রাহানের চোখ থাকছে বাউন্ডারির দিকে। চেনা ওয়াংখেড়েতেও মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে রবিবারের মেজাজে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। করেছিলেন ২৭ বলে ৬১ রান।
এখনও পর্যন্ত ১৫৩টি আইপিএল ম্যাচের ৩২টি ইনিংসে রাহানে ব্যাট করেছেন ১৭ থেকে ২০ ওভারের মধ্যে। অর্থাৎ ম্যাচের স্লগ ওভারে। তবু রাহানের ব্যাটে কখনও এমন দাপট দেখা যায়নি। মূলত উইকেটের এক দিক আগলে রাখতেই দেখা যেত তাঁকে। তিনি স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকলে অনেক সময় কমেছে রান ওঠার গতি। এ বার ঠিক বিপরীত। রাহানে স্ট্রাইকে মানেই হু হু করে বেড়েছে রান তোলার গতি। টেস্ট ক্রিকেটের অফ ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ, হুক, পুল সব রয়েছে তাঁর ব্যাটে। বদল বলতে শুধু ২০ ওভারের ক্রিকেটের মোড়কে।
কী ভাবে এতটা বদলানো যায়? রাহানে বলেছেন, ‘‘মানসিকতাটাই আসল। কেউ কিছু করব মনে করলে, ঠিক করতে পারে। সব সময় বিশ্বাস করেছি, ভাবনাটাই আসল। এই মরসুম শুরুর আগে একটা ঠান্ডা মাথায় পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রস্তুতিটাও দারুণ ছিল। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে আমাদের প্রস্তুতি শিবিরও ভাল হয়েছিল। শুধু চেয়েছিলাম, এ বার ম্যাচগুলোকে শুধু উপভোগ করব। মাথায় আর কিছু রাখিনি।’’ এখনও পর্যন্ত ৫টি ম্যাচ খেলে করেছেন ২০৯ রান। গড় ৫২.২৫। স্ট্রাইক রেট ১৯৯.০৪। চার মেরেছেন ১৮টি। ছক্কা ১১টি। এই রাহানের নেতৃত্বেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পিছিয়ে পড়েও টেস্ট সিরিজ় জিতেছিল ভারত। কে বলে রাহানের মধ্যে আগুন নেই!
রবিবার ম্যাচের পর ধোনি বলেছিলেন, রাহানের উপর কোনও চাপ দেননি। অভিজ্ঞ ব্যাটারের উপর আস্থা রেখেছিলেন আর পছন্দ মতো জায়গায় খেলার সুযোগ দিয়েছেন। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন রাহানে। সেই ধোনি, যিনি এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিংয়ের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সীমাবদ্ধতার বেড়া ভেঙে শুধুই রাঙাচ্ছেন রাহানে। আক্ষেপ একটা আছে তাঁর। বলেছেন, ‘‘ওয়াংখেড়েতে কখনও টেস্ট খেলিনি। অন্তত একটা খেলতে চাই।’’
গত বছর কার্তিকের পারফরম্যান্স জায়গা করে দিয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে। এ বারও একটা বিশ্বকাপ আছে। এক দিনের। রাহানেকে টেস্ট দল থেকেও বাদ দেওয়া জাতীয় নির্বাচকদের সাহসী হতে হবে। রাহানের সাহসী ব্যাটিংয়ের মতোই। মুম্বইকর বলেছেন, ‘‘এখনও সেরা খেলাটা খেলিনি।’’ এটাই এত ভয়ঙ্কর সুন্দর, সেরাটা না জানি আরও কত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy