Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

বিদ্রোহী কবির উপহার দেওয়া পেনসিলই আমার জীবনের সেরা পুরস্কার

বয়স আশি পেরিয়ে গিয়েছে তাঁর। অসুস্থতার কারণে বন্ধ হাঁটাচলা। ভরসা একমাত্র হুইল চেয়ার। কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রসঙ্গ উঠলেই বদলে যায় অভিব্যক্তি। তিনি, প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন তাঁর শৈশবের অজানা কাহিনি।বয়স আশি পেরিয়ে গিয়েছে তাঁর। অসুস্থতার কারণে বন্ধ হাঁটাচলা। ভরসা একমাত্র হুইল চেয়ার। কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রসঙ্গ উঠলেই বদলে যায় অভিব্যক্তি। তিনি, প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন তাঁর শৈশবের অজানা কাহিনি।

অবসর: প্রিয় পোষ্যর সঙ্গে নিজের ঘরে নিরালায়। নিজস্ব চিত্র

অবসর: প্রিয় পোষ্যর সঙ্গে নিজের ঘরে নিরালায়। নিজস্ব চিত্র

শুভজিৎ মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনার জন্ম তো জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে। যদিও শৈশবে উত্তরবঙ্গ ছেড়ে জামশেদপুর চলে গিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের কোনও স্মৃতি মনে আছে?

প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (পিকে): অবশ্যই। উত্তরবঙ্গ নিয়ে আমি ভীষণই আবেগপ্রবণ। বাবা জামশেদপুরে চাকরি পাওয়ায় আমাদের উত্তরবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তখন আমার বয়স ছিল নয় বা দশ বছর। বয়স ৮০ পেরিয়ে গেলেও উত্তরবঙ্গের সমস্ত স্মৃতিই উজ্জ্বল।

প্র: কী রকম?

পিকে: আমাদের গ্রামটা ছিল লাটাগুড়ি জঙ্গলের লাগোয়া। ফলে লেপার্ডের খুব উৎপাত ছিল। আমার বাবার দু’টো পোষ্য ছিল। পাহাড়ি কুকুর। যত দূর মনে পড়ে একটার নাম ছিল বেবি। অন্যটার নাম ভুলে গিয়েছি। ওদের চিতাবাঘ তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির বারান্দা থেকে।

প্র: সেকি! কী ভাবে?

পিকে: সেই সময় উত্তরবঙ্গের বাড়িগুলোর অধিকাংশই কাঠের ছিল। প্রচুর বৃষ্টি হত বলে কাঠের গুঁড়ির উপর বাড়িগুলো তৈরি করা হত মাটি থেকে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচুতে। আমাদের একতলাটা ছিল কলকাতার দোতলা বাড়ির সমান। সেই বাড়ির বারান্দায় রাতে দুই পোষ্যকে বেঁধে রাখতেন বাবা। কারণ, কুকুরের মাংস লেপার্ডের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বাবার ভয় ছিল, বেঁধে না রাখলে ওরা জঙ্গলে চলে যাবে। আর লেপার্ড ওদের মেরে ফেলবে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়। বারান্দায় আমাদের কুকুর দু’টোকে খেতে দেওয়া হয়েছিল। এমন সময় অতর্কিতে আক্রমণ করে চিতাবাঘ। ওরা প্রচণ্ড চিৎকার করেছিল। কিন্তু আমাদের বাড়ির সকলে ভেবেছিল, বেঁধে রাখা হয়েছে বলে হয়তো চিৎকার করছে। তাই আর কেউ বাইরে যায়নি। খানিক্ষণ পরে চিৎকার থেমে গেল। পরের দিন সকালে উঠে বাবা দেখলেন, কুকুর দু’টো নেই। বারান্দার মেঝেতে রক্তের দাগ। খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। বাবার মতো কড়া মানুষও কেঁদে ফেলেছিলেন।

প্র: জঙ্গলের পাশে থাকতে ভয় করত না?

পিকে: একেবারে ভয় করত না বলব না। উত্তরবঙ্গে মাঝেমধ্যেই প্রবল ঝড় হত। সেই সময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্ত শব্দ ভেসে আসত। আমি তাতে খুব ভয় পেতাম। তবে বর্ষার সময় খুব আনন্দ হত।

প্র: কেন?

পিকে: বর্ষার সময় উত্তরবঙ্গের রূপটাই বদলে যায়। গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ ও নানা রকমের পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমি পড়তাম জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে। বর্ষার সময় আমাদের স্কুলে ছুটি দেওয়া হতো। সেই দিনগুলো আর আমার জীবনে কখনও ফিরে আসেনি।

প্র: ফুটবল শিক্ষার শুরু কি ময়নাগুড়িতেই?

পিকে: হ্যাঁ। বাবা-ই আমার প্রথম কোচ। তাঁর পা ধরেই ফুটবলের শিক্ষা শুরু। আমি তখন ছয়। বাবা আমার জন্য একটা এক নম্বর ফুটবল কিনে এনেছিলেন। বছর দু’য়েক পরে ময়নাগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি চলে যাওয়ার পরে খেলা শিখিয়েছেন মোজাম্মেলদা, টি মল্লিক, মন্টু মল্লিকের মতো কলকাতায় খেলে যাওয়া ফুটবলাররা। তবে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি জামশেদপুরে যাওয়ার পরে। শুধু ফুটবল নয়, মাছ ধরতেও শিখিয়ে ছিলেন বাবা। জলপাইগুড়ি চলে আসার পরে বাবা তিস্তায় মাছ ধরতে যেতেন। সঙ্গে যেতাম আমি। বাবার ছিল হুইল লাগানো ছিপ। আমার ছিল সাধারণ ছিপ। বাবা ধরতেন বড় বড় মাছ। আমি ধরতাম পুঁটি, খলসে ও ট্যাংরা জাতীয় মাছ।

প্র: বাবার কাছে কখনও বকুনি খেয়েছেন?

পিকে: ওরে বাবা, খাইনি আবার! আমার বাবা ছিলেন ভয়ঙ্কর রাগি। ছয় বছর বয়সে বাবার হাতে খাওয়া চড় এখনও ভুলিনি।

কখনও বাইরে বেরোনো। তবে এখন বাইরে যাওয়া কমে গিয়েছে। নিজস্ব চিত্র

প্র: কী করেছিলেন?

পিকে: আমার তখন বছর ছ’য়েক বয়স। ময়নাগুড়ির পাঠ চুকিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে চলে এসেছি। বাবা খুব ভাল অভিনয় করতেন বলে, দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। একবার বাবা একটি নতুন সিগারেটের প্যাকেট এনেছিলেন। বাবার ডাক নাম ছিল হাবু। দেখলাম সবাই তাঁকে বলছেন, ‘‘হাবু আমাকে একটা।’’ আর বাবা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দিচ্ছেন। আমিও বললাম, ‘‘বাবা আমাকে একটা।’’ ব্যস, প্রচণ্ড রেগে আমার গালে একটা চড় মারলেন। এত জোর ছিল সেই চড়ে যে, আমি ছিটকে পড়ে গিয়েছিলাম তিন-চার হাত দূরে। আমার মুখও বেঁকে গিয়েছিল। এখনও সেই ঘটনা মনে পড়লে কেঁপে উঠি। আরেক বার প্রচণ্ড মার খেয়েছিলাম গাছে ওঠার জন্য। পিঁপড়ের ডিম খাওয়ার জন্য ভাল্লুক গাছে উঠে বসে থাকত। তাই বাবা বারবার বারণ করতেন গাছে উঠতে। কিন্তু আমি শুনতাম না। বাবাকে লুকিয়ে প্রায়ই গাছে উঠে পড়তাম। যেদিন ধরা পড়তাম, প্রচণ্ড মার খেতাম।

প্র: এত প্রিয় উত্তরবঙ্গ ছেড়ে তা হলে জামশেদপুর চলে গিয়েছিলেন কেন?

পিকে: জামশেদপুরে আমাদের এক আত্মীয় থাকতেন। তিনিই বাবার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাই আমরাও যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।

প্র: কষ্ট হয়নি?

পিকে: প্রচণ্ড কেঁদেছিলাম জলপাইগুড়ি ছাড়ার সময়।

প্র: প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তো ফিরে যেতে পারতেন উত্তরবঙ্গে?

পিকে: তা সম্ভব ছিল না। কারণ, ময়নাগুড়ি ও জলপাইগুড়িতে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তা বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন জামশেদপুর যাওয়ার সময়। তবে পরবর্তীকালে বহুবার সেই বাড়ি দু’টো দেখতে গিয়েছিলাম।

প্র: কী রকম অনুভূতি হয়েছিল?

পিকে: ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ভাল লাগা ও যন্ত্রণা মিলিয়ে আশ্চর্য একটা অনুভূতি হয়েছিল।

প্র: উত্তরবঙ্গের সেরা স্মৃতি কী?

পিকে: কাজি নজরুল ইসলামের দেওয়ার পেনসিল উপহার।

প্র: বিস্তারিত যদি বলেন?

পিকে: আমরা তখন ময়নাগুড়িতে থাকতাম। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমাদের স্কুলে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি। আমি একা ছবি এঁকে উপহার দিয়েছিলাম ওঁকে। দারুণ পছন্দ হয়েছিল ওঁর ছবিটা। খুশি হয়ে আমাকে একটি পেনসিল উপহার দিয়েছিলেন। আমার জীবনের সেরা পুরস্কার।

প্র: ফিফার বিচারে বিংশ শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ফুটবলারের খেতাব। পদ্মশ্রীর চেয়েও সেরা?

পিকে: অবশ্যই। কাজি নজরুল ইসলাম নিজের হাতে পুরস্কার দিচ্ছেন, তার চেয়ে কোনও পুরস্কারই মূল্যবান নয়।

প্র: এ বার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। সামনেই বিশ্বকাপ ফুটবল। কে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে বলে মনে করেন?

পিকে: ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হলে বেশি খুশি হব। তবে মনে হয় না ওরা পারবে। এই বিশ্বকাপে জার্মানির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ওদের দলটা অনেক বেশি গোছানো।

প্র: লিয়োনেল মেসি না ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো— কে সেরা?

পিকে: দু’জনেই দুর্দান্ত ফুটবলার। মেসির শিল্প বিস্মিত করে। রোনাল্ডোর পরিশ্রম ও হার না মানা মানসিকতা আমাকে মুগ্ধ করে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE