গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ছবি: পিটিআই।
কথায় আছে, ক্রিকেট দলগত খেলা। এখানে একার হাতে ম্যাচ জেতানো যায় না। সেই পুরনো কথাই আরও এক বার অসত্য প্রমাণ করে দিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কী ভাবে একার হাতে ম্যাচ জেতানো যায়, তা সোমবার আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রমাণ করে দিলেন তিনি। আগামী বহু বহু বছর, যখনই ক্রিকেটে কোনও দল রান তাড়া করতে নামবে, তখনই ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস দেখে নামতে পারে তারা। এক দিনের ক্রিকেটে আগে কোনও দিন এই ইনিংস দেখা যায়নি। বিশ্বকাপ চলতে থাকলেও টি-টোয়েন্টির দাপটে অস্তিত্বরক্ষায় ধুঁকছে এক দিনের ক্রিকেট। মঙ্গলবার ম্যাক্সওয়েলের ইনিংস বুঝিয়ে দিয়ে গেল, এক দিনের ক্রিকেটে ‘প্রাণ’ এখনও রয়েছে। ১২৮ বলে ২০১ রানের ইনিংস আজীবন থেকে যাবে ক্রিকেট ইতিহাসে।
কী ভাবে খাদের কিনারা থেকে কোনও দল ঘুরে দাঁড়িয়ে, প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে একটা ম্যাচ জিততে পারে, তার আদর্শ প্রমাণ হয়ে থাকবে সোমবার আফগানিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। দু’মাস আগেই বাবা হয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। ছেলে যদি ক্রিকেটার হতে চায়, তা হলে নিজের ইনিংস দেখিয়ে তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারেন। বলা বাহুল্য, অনুপ্রেরণার কোনও অভাব হবে না।
অবাক করা ব্যাপার এটাই যে, নিজের ইনিংসের সিংহভাগটাই ম্যাক্সওয়েল খেললেন কার্যত ‘এক পায়ে’। শতরানের আগে থেকেই পায়ের পেশিতে টান ধরা শুরু হয়েছিল। যত ইনিংস গড়াল সেই ব্যথা বাড়ল। কয়েক ওভার অন্তর মাঠের ধার থেকে ছুটে আসছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট স্টাফেরা। প্রথমে ম্যাসাজ, তার পরে ব্যথা কমানোর ওষুধ— চেষ্টা করা হল অনেক কিছুরই। কিন্তু অসম্ভব মানসিক জেদ না থাকলে এই ইনিংস খেলা সম্ভব নয়। ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসকে তাই অতিমানবীয় বললেও কম বলা হয়। আগে ব্যাট করে অনেকেই দাপট দেখিয়েছেন, অনেকেই দাপুটে ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু রান তাড়া করতে নেমে, দলের শেষ ভরসাযোগ্য ব্যাটারকে নিয়ে প্রায় একার কাঁধে দলকে জেতানো, এ জিনিস অনেক দিন দেখা যায়নি।
নবম ওভারে ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে এলেন, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা তখন বেশ খারাপ। ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে তারা। প্রথম দু’বলে ডেভিড ওয়ার্নার এবং জশ ইংলিসকে তুলে নিয়ে পিচে আগুন ঝরাচ্ছেন আজমাতুল্লা। তাঁর হ্যাটট্রিক আটকানোই প্রথম কাজ ছিল ম্যাক্সওয়েলের। অফস্টাম্পে পড়া বল তাঁর ব্যাটের কানায় লেগে থার্ড ম্যান এলাকা দিয়ে বাউন্ডারিতে চলে যায়। আফগানিস্তান মরিয়া হয়ে রিভিউ নিয়েছিল। পরিষ্কার দেখা যায় বল তাঁর ব্যাটে লেগেছে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ফুটতে থাকা আফগানিস্তান হাল ছাড়েনি। এক দিকে ম্যাক্সওয়েল টিকে গেলেও উল্টো দিকে একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে।
৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। তখন মনে হচ্ছিল, আফগানিস্তানের বিরাট জয় এবং আরও একটা অঘটন সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ক্রিকেট-বিধাতা এই ম্যাচের ভাগ্য অন্য রকম লিখে রেখেছিলেন তা কে জানত। ম্যাক্সওয়েল এর পর একটাই সুযোগ দিয়েছিলেন ৩৩ রানের মাথায়। নুর আহমেদের বলে সুইপ করেছিলেন। শর্ট ফাইন লেগে লোপ্পা ক্যাচ মিস্ করেন মুজিব উর রহমান। ওই মিসের জন্যে তিনি সারাজীবন আক্ষেপ করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওই একটা ক্যাচই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিল আফগানিস্তানকে।
১৯৯৯ সালে এ ভাবেই একটি অসামান্য ইনিংস খেলেছিলেন তৎকালীন অসি অধিনায়ক স্টিভ ওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সুপার নাইনের সেই ম্যাচে ৫৬ রানে তাঁর ক্যাচ ফেলেছিলেন হার্শেল গিবস। পরে স্টিভ বলেছিলেন, ‘‘ওহে গিবস, তুমি ক্যাচ নয়, বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে।’’ এ দিন মুজিবের মিসের পরেও ম্যাক্সওয়েল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘‘ওহে মুজিব, তুমি ক্যাচ নয়, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্নটাই ফেলে দিলে।’’
মুম্বইয়ের প্রচণ্ড আর্দ্রতার মধ্যে লম্বা ইনিংস খেলা সহজ নয়। যতই মাঠ ছোট হোক এবং বড় শট খেলা সহজ হোক, দীর্ঘ ক্ষণ একই ছন্দে ইনিংস খেলে যাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার। মানসিক ভাবে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকলেও শারীরিক ভাবে সমস্যায় পড়ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। শতরানের আগে থেকেই পায়ের পেশিতে টান ধরা শুরু হল। দু’বার মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়লেন। পিঠে, কোমরে চাপ দিয়ে ম্যাক্সওয়েলকে সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা। অন্য কোনও ক্রিকেটার হলে খারাপ কোনও শট খেলে উইকেট দিয়ে আসতেন।
কিন্তু ম্যাক্সওয়েল অন্য ধাতুতে গড়া। নিজের দিনে তাঁকে থামানো কঠিন। শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না বলে দৌড়ে রান নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা শুরু করলেন। তাতেও আফগানিস্তান বোলারেরা আটকাতে পারলেন না। অবলীলায় চার-ছক্কা মেরে গেলেন ম্যাক্সওয়েল। এমনকি সুইচ হিটেও চার মেরে দিলেন। শেষ ওভারে ছয়, ছয়, চার এবং ছয় মেরে নিজের দুশো তো পূর্ণ করলেনই, অস্ট্রেলিয়াকেও জয়ের তরী পার করে দিলেন।
ইংল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে হারিয়ে অঘটন ঘটানো আফগানিস্তান স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল আরও একটি অঘটনের। সেই অঘটন হল না তাদের নিজেরই দোষে। ম্যাক্সওয়েল ক্রিজে থিতু হয়ে যাওয়ার পরেও অধিনায়ক হাসমাতুল্লা শাহিদি সেই বোলারদের দিয়েই বল করিয়ে গেলেন, যারা মার খাচ্ছেন। রশিদ খানের বলের বিরুদ্ধে ম্যাক্সওয়েলের দুর্বলতার কথা জেনেও তাঁকে আনলেন দেরিতে। ক্রমাগত বল করিয়ে গেলেন মুজিব এবং নুরকে দিয়ে। ম্যাক্সওয়েলকে দু’জনেই বিন্দুমাত্র বিব্রত করতে পারেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy