আকাশ দীপ। —ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশ সিরিজ়ের আগে ঝুলিতে ম্যাচ বলতে ছিল একটাই টেস্ট। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি না খেলায় জায়গা পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দলে জায়গা পাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। লড়াই ছাড়েননি আকাশ দীপ। দলীপ ট্রফিতে একটি ম্যাচেই নজর কাড়েন বাংলার পেসার। সেই পারফরম্যান্সের কারণেই মুকেশ কুমার, আরশদীপ সিংহদের টপকে জায়গা পেয়ে যান দলে। কিন্তু চেন্নাইয়ের মাঠে তিন পেসার খেলানো ছিল অলীক স্বপ্ন। আকাশ নিজেও কি ভাবতে পেরেছিলেন তিন পেসার খেলাবেন গৌতম গম্ভীর, রোহিত শর্মারা? খেলালেন। হয়তো সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন আকাশ। প্রথম ওভারেই জোড়া উইকেট। পর পর দুই বলে। ওই একটা স্পেলই তাঁর খেলা নিশ্চিত করে দিল দ্বিতীয় টেস্টে। বাংলাদেশকে চুনকাম করে সিরিজ় জেতার পরে অধিনায়ক রোহিত শর্মা থেকে প্রধান পেসার যশপ্রীত বুমরা, সকলের মুখে আকাশের নাম। এই দু’টি টেস্টেই কি অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের দরজা খুলে ফেললেন এই ডানহাতি পেসার?
চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্টের প্রথম স্পেল
চেন্নাইয়ে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে রোহিত কিন্তু তৃতীয় পেসার হিসাবেই আকাশকে এনেছিলেন। প্রথম ওভারে বুমরা উইকেট নিলেও তার পরে ধীরে ধীরে জুটি গড়ছিল বাংলাদেশ। মহম্মদ সিরাজ উইকেট পাননি। আকাশ এসে প্রথম ওভারেই নজর কাড়লেন। প্রথম বলেই তিনি আউট করলেন জ়াকির হাসানকে। পেসারেরা সাধারণত বল শুরু করেন ওভার দ্য উইকেট থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাঁহাতি ব্যাটারদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই রাউন্ড দ্য উইকেট বল করলেন আকাশ। তাঁর বল অফ স্টাম্পে পড়ে ভিতরে ঢুকল। জ়াকির সামনের পায়ে খেলতে গেলেন। বল ব্যাট-প্যাডের মাঝখান দিয়ে উইকেটে গিয়ে লাগল। পরের বলে আবার সেই এক ছবি। এ বার ব্যাটারের নাম মোমিনুল হক। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ১২টি শতরান থাকা মোমিনুলও একই ভুল করলেন। সামনের পায়ে খেলতে গেলেন। বুঝতে পারেননি আকাশের বল এতটা ভিতরে ঢুকবে। হ্যাটট্রিকের সুযোগ থাকলেও আসেনি। ৫ ওভারের স্পেলে ১৯ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন আকাশ। আর বল পাননি প্রথম ইনিংসে। কিন্তু ওই একটি স্পেলেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কতটা ভাল পেসার তিনি।
কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টেও সফল
কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টেও শুরুটা করেননি আকাশ দীপ। তৃতীয় পেসার হিসাবে আসেন। তার আগে বাংলাদেশের দুই ওপেনার শাদমান ইসলাম ও জ়াকির ধরে খেলছিলেন। বুমরা ও সিরাজের বলে উইকেট দেননি তাঁরা। কিন্তু আকাশের বিরুদ্ধে সামলাতে পারলেন না। আবার নিজের প্রথম ওভারেই জ়াকিরকে আউট করেন আকাশ। তাঁর বাইরের দিকে যাওয়া বলে ব্যাট লাগিয়ে গালি অঞ্চলে ক্যাচ আউট হন বাংলাদেশের ব্যাটার। কয়েক ওভার পরে শাদমানকেও আউট করেন আকাশ। আম্পায়ার প্রথমে আউট দেননি। রোহিতকে রিভিউ নিতে বলেন আকাশ। বল লেগ স্টাম্পে লেগেছিল। রোহিত নিশ্চিত ছিলেন না। রিভিউ নিতে চাইছিলেন না। কিন্তু আকাশ নাছোড়বান্দা। জোর করতে থাকেন। বাধ্য হয়ে রোহিত রিভিউ নেন। কিন্তু রিভিউতে যখন দেখা যায় বল উইকেটে লাগছে, তখন সকলের আগে রোহিতই জড়িয়ে ধরেন আকাশকে। প্রথম ইনিংসে ১৫ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন আকাশ।
দ্বিতীয় ইনিংসেও ভাল বল করেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে এক দিক ধরেছিলেন শাদমান। অর্ধশতরান করা শাদমানকে ফেরত পাঠান আকাশ। ৮ ওভারে ২০ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন। বাংলাদেশের দুই ওপেনার শাদমান ও জ়াকিরকে দু’বার করে আউট করেন তিনি। অথচ প্রতি ক্ষেত্রেই তৃতীয় পেসার হিসাবে বল করতে এসেছেন। এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, রোহিতদের শুরুটা করে দিয়েছেন আকাশ। বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রথম ধাক্কা দেওয়ার জন্য আকাশের দিকে তাকাতে পারেন অধিনায়ক।
লম্বা স্পেল, উইকেট টু উইকেট বোলিং
আকাশ দীপের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর বলের লাইন ও লেংথ। বেশির ভাগ সময়ে উইকেট টু উইকেট বল করেন তিনি। অর্থাৎ, বল শেষ হয় উইকেটে গিয়ে। এই ধরনের বল খেলতে ব্যাটার বাধ্য হন। খুব একটা বেশি বল ছাড়া যায় না। ব্যাটারকে এক জন বোলার যত বেশি খেলাবেন তত তাঁর সুযোগ থাকবে উইকেট নেওয়ার। সেটাই আকাশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সেই কারণে, তাঁর পাঁচটি উইকেটের মধ্যে তিনটি বোল্ড, একটি এলবিডব্লিউ ও দু’টি উইকেটের পিছনে ক্যাচ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবশ্য একটি পিছনের লেংথে বল করেন আকাশ। বাউন্সারও ভাল করেন। তাঁর বলের গতি রয়েছে। লম্বা স্পেল করতে পারেন।
একজন অধিনায়ক এই ধরনের বোলারকে পছন্দ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আকাশ দীপের পরিশ্রমের কথা জানিয়েছেন রোহিত। বাংলাদেশকে হারিয়ে উঠে তিনি বলেন, “আকাশ দীপ খুব ভাল বল করেছে। ও অনেক ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছে। তাই জানে ভারতে কেমন উইকেট হয়। এই উইকেটে কেমন বল করতে হয় সেই ধারণাও ওর আছে। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে পরিশ্রম করে নিজের জায়গা করে নেওয়া লম্বা স্পেল করার ক্ষমতা ওর আছে। ওর শারীরিক গঠনও দুর্দান্ত। তাই এত ফিট থাকতে পারে। ওকে দেখে খুব ভাল লাগছে।” বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলতে পারেননি শামি। নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ়ে তিনি ফিরলে হয়তো আকাশ দীপকেই বাইরে বসতে হবে। সেই প্রসঙ্গে রোহিত মনে করিয়ে দিলেন বেঞ্চের শক্তির কথা। তিনি বলেন, “এখন অনেক ম্যাচ খেলতে হয়। তাই বেঞ্চকে সব সময় তৈরি রাখতে হয়। সেটাই আমরা করছি। ভাল বল করলে সুযোগ আসবেই। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।” বাংলাদেশকে হারিয়ে ট্রফি তোলেন রোহিত। তার পরে সেই ট্রফি তিনি তুলে দেন আকাশ দীপের হাতে। ভারতীয় দলে অনেক বছর ধরে এই রেওয়াজ রয়েছে। দলের সবচেয়ে নতুন সদস্য ট্রফি তোলেন। এই দলে আকাশ দীপ সবচেয়ে নতুন। তাই তিনিই ট্রফি হাতে উল্লাস করলেন। তাঁর সঙ্গে সিরিজ় জয়ের আনন্দে মাতলেন বাকিরা।
শেখার ইচ্ছা আরও উন্নত করেছে
আকাশ দীপের শেখার ইচ্ছা তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদ করে তুলেছে। এই দলে পেস আক্রমণের নেতা বুমরা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সেই বুমরার সঙ্গে আকাশের কেমন সম্পর্ক? বুমরা জানিয়েছেন, মাঠে বার বার তাঁর সঙ্গে কথা বলেন আকাশ। বুমরার কথায়, “ও প্রত্যেক বার বল করার আগে আমার কাছে আসে। জিজ্ঞাসা করে যে পিচ কেমন। কী ভাবে বল করা উচিত? বল করার সময় নিজের সেরাটা দেয়। দুর্দান্ত ফিল্ডার। যত ক্ষণ মাঠে থাকে সারা ক্ষণ চনমনে থাকে। ওর পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে আমি অবাক হই। আকাশ দীপ যখন বল করতে যায় তখন আমরা অপেক্ষা করি কখন উইকেট পড়বে। প্রতি দিন আরও উন্নতি করছে আকাশ দীপ। আমি নিশ্চিত আগামী দিনে ও আরও ভাল বল করবে।”
মুকেশকে ছাপিয়ে গিয়েছেন
আকাশের আগে ভারতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন মুকেশ কুমার। তাঁরও অভিষেক হয়েছিল টেস্টে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুকেশকে ছাপিয়ে গিয়েছেন আকাশ। তার অন্যতম বড় কারণ বলের নিয়ন্ত্রণ। এমনটাই মনে করেন বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “নতুন বলটা ভাল কাজে লাগিয়েছে আকাশ দীপ। হয়তো ওর বলের গতি বুমরা বা সিরাজের মতো নয়, তবে ও বরাবর স্টাম্প টু স্টাম্প বল করে এই সুবিধাটা তুলে নিয়েছে। এই জায়গায় আমি ওকে মুকেশের থেকে খানিকটা এগিয়ে রাখছি।”
ব্যাট হাতেও কার্যকরী
আরও একটি ক্ষেত্রে বাকি বোলারদের টেক্কা দিতে পারেন আকাশ দীপ। সেটি হল তাঁর ব্যাট করার ক্ষমতা। বড় শট খেলতে পারেন। চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩০ বলে ১৭ রান করেছেন। মেরেছেন চারটি চার। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পাননি। কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে পাঁচ বলে ১২ রান করেছেন। মেরেছেন দু’টি বিশাল ছক্কা। বিরাট কোহলির ব্যাট নিয়ে নেমেছিলেন তিনি। তাঁর ছক্কা দেখে সাজঘরে বসে হাসতে দেখা যায় কোহলিকেও।
বাংলার ক্রিকেটমহল জানে, আকাশ ব্যাট হাতে কতটা কার্যকরী। তাঁকে তৈরি করার নেপথ্যে রয়েছেন বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল। শেষ দু’বছরে লক্ষ্মীর বিভিন্ন উপদেশে উন্নতি করেছেন আকাশ। জায়গা করে নিয়েছেন ভারতীয় দলে। সেই লক্ষ্মী আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “আকাশকে দীর্ঘ ক্ষণ ব্যাটিং অনুশীলন করিয়েছি। মরসুম শুরুর আগে সিউড়িতে বাংলা দলের যে শিবির হয়েছিল, সেখানেও ব্যাটিং অনুশীলন করেছিল আকাশ। ও ব্যাট হাতেও উন্নতি করতে চায়। বোলার হিসাবে আকাশ কেমন তা সকলেই জানে, কিন্তু ও ব্যাটটাও করতে পারে। যে কোনও দলের জন্যই তাই লোয়ার অর্ডারে ভরসা হয়ে উঠতে পারে আকাশ।” প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৮৬ রান রয়েছে আকাশের। ভারতের হয়েও ব্যাট হাতে ভাল করতে চান তিনি।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের দরজা কি খুলে ফেলেছেন
বাংলাদেশ সিরিজ়ে আকাশ দীপ যা পারফর্ম করেছেন তাতে তার পরে ভারতীয় দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া কঠিন। নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ়ে দলে ফিরতে পারেন মহম্মদ শামি। তার পরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া সফর। নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ়ে ভারতের বোলিং আক্রমণ কেমন হবে তা নির্ভর করছে পিচের উপর। ভারতের মাটিতে যদি দুই পেসার ভারত খেলায় তা হলে বুমরা ও সিরাজের খেলার সম্ভাবনা বেশি। চোট সারিয়ে ফেরা শামির উপর বেশি ধকল দিতে চাইবে না ম্যানেজমেন্ট। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচ টেস্টের কথা মাথায় রেখে বুমরাকেও বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে খেলতে পারেন আকাশ। অস্ট্রেলিয়ায় তিন পেসার খেলাবে ভারত। সেখানে বুমরা, শামি ও সিরাজ প্রথম পছন্দ হলেও আকাশ যদি নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন, তা হলে নিজের জায়গা করে নিতে পারেন তিনি। বড় সিরিজ়ে অনেক সময় পেসারদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলানো হয়। সেখানেও আকাশ থাকবেন রোহিতদের চতুর্থ পেসার। অস্ট্রেলিয়া সফরে অন্তত চার জন পেসার নিয়ে যাবে ভারত। প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়া নিয়ে তর্ক থাকলেও বাংলাদেশ সিরিজ়ের পরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের দলে নিজের জায়গা প্রায় পাকা করে নিয়েছেন বাংলার পেসার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy