আমি খুব ছোট থেকে সাঁতার কাটা শুরু করেছি। তখন মাত্র ২ বছর বয়স আমার। ৫ বছর বয়সে বাবা শ্রীরামপুর সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দেন। বাড়ি থেকে অনেক দূরে রোজ বাসে, ট্রেনে করে যেতে হত। কারণ বাড়ির কাছে কোনও সুইমিং পুলই ছিল না। আর সুইমিং কস্টিউম পরে পাড়ার পুকুরে নামার কথাতো ভাবতেই পারতাম না। সুইমিং কস্টিউম তো দূরের কথা, একটা মেয়ের ট্র্যাকস্যুট পরাটাই তখন সমাজের চোখে অপরাধ। আমার নিজেরও লজ্জা লাগত। ভোর বেলা সাড়ে তিনটে-চারটের সময় উঠে দৌড়তে যেতাম যাতে কেউ দেখতে না পায়। তারপর বাড়ি এসে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়িতে একটা পুকুর ছিল। আমি খুব ছোট থেকেই বিভিন্ন জায়গায় যেতাম সাঁতারের জন্য। বাবা বুঝেছিলেন মেয়ের প্র্যাকটিসের প্রয়োজন। তাই পুকুরের চারপাশে পাঁচিল তুলে নিজেই বাঁধিয়ে দেন যাতে কেউ দেখতে না পায় মেয়ে সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কাটছে। তবে একটা সময়ের পর থেকে আমি বুঝে গিয়েছিলাম । কারণ সুইমিং কস্টিউম আমার কাছে ভগবানের মতো। সরস্বতী পুজোর সময় যেমন পড়ুয়ারা বই, খাতা ঠাকুরের আসনে রাখে, আমি রাখতাম আমার কস্টিউম, সুইমিং ক্যাপ, গগল। সেই কস্টিউমকে যখন কেউ কুদৃষ্টিতে দেখত তখন মনে মনে বলতাম ভগবান এদের ক্ষমা করে দাও। এরা অবুঝ। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। সে দিন এরা বুঝবে। আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে সেটা করে দেখিয়েছি, আজ সাক্ষী, দীপা, সিন্ধুরাও দেখিয়ে দিল।
রাষ্ট্রপতি ভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের হাত থেকে খেলরত্ন পুরস্কার নিচ্ছেন বুলা চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
দীপাদের মতো জিমন্যাস্টদের তো অবস্থা আরও সঙ্গীন। ওদের কস্টিউম পরে ডান্স করতে হয়। আমাদের একটা সুবিধা ছিল। ঝুপ করে জলের তলায় চলে যেতে পারতাম। গঙ্গায় যখন দূপরাল্লার সাঁতার কাটতাম তখন ঘোলা জলে নিশ্চিন্ত থাকতাম। কিন্তু মাকে একটা তোয়ালে হাতে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। যাতে আমি ডাঙায় উঠলেই তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে নিতে পারে। কেউ দেখতে না পায় মেয়ের ভেজা শরীর। কিন্তু তাতেও কি রেহাই মিলত কুদৃষ্টি থেকে?
মেয়ে বলে অনেক নোংরা রাজনীতিও সহ্য করতে হয়েছে। সহ্য করেছি বললে ভুল হবে, বলা উচিত দেখতে হয়েছে। কারণ সহ্য আমি করিনি। বরাবর প্রতিবাদ করেছি। আর সেই কারণেই আরও বেশি চক্ষুশূল হয়েছি। একে মেয়ে, তায় প্রতিবাদী। তবে ঈশ্বরের কৃপায় আমি বরাবর এক নম্বর ছিলাম তাই বেশি কিছু করতে পারেনি। তাও যখনই পেরেছে আমার গলা কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। সুইমিং পুলে শর্ট ডিসট্যান্সে আমি অর্জুন পেয়েছি। কোনও ছেলে আজ পর্যন্ত পায়নি। আমাকে বলা হয়েছিল, কী ভাবে অর্জুন পাও তুমি দেখে নেবো। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম এমন একটা কিছু করতে হবে যা কোনও ছেলেও করে দেখাতে পারেনি। এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। এমনকী, আমি বিয়েটাও করি এমনই একটা ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে। ২৩ বছর বয়সে যখন বিয়ে করি তখনই আমার স্বামীকে বলে নিয়েছিলাম সাঁতার আমার প্রথম প্রেম। তারপর আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। সাঁতার ছাড়া আমি ভাল থাকব না। আর নিজে ভাল না থাকলে আমি কাউকে ভাল রাখতেও পারব না।
জলের বুকে বুলা চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
দীপা, সিন্ধু, সাক্ষীকে দেখে আজ তাই খুব ভাল লাগছে। জানি এখন সমাজ অনেক বদলেছে। কিন্তু এখনও অনেক বাকি। ওদেরও অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি নয়। বিয়ে করে স্বামী, সন্তান নিয়ে সংসার করাটাই তাদের একমাত্র কাজ নয়। মেয়েরা সব কিছু করতে পারে। তাই আমি সকলকে বলতে চাই মানুষকে প্রতিভা দিয়ে বিচার করুন। ছেলে বা মেয়ে দিয়ে নয়। যার প্রতিভা রয়েছে, পরিশ্রম করলে সে একদিন সফল হবেই। আজ অলিম্পিকে মেয়েরাই পদক এনে দিল। দেশকে শুধু সম্মানিতই করল না, পরিবারগুলো ওদের জন্যই আজ কোটিপতি।
আর যেই সব মেয়েরা লড়াই করছ তাদের বলব অনেকে অনেক কিছু বলবে। শুধু পাখির চোখে লক্ষ্য স্থির রাখো, আর পরিশ্রম করো। নাথিং ইজ ইমপসিবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy