ছকভাঙা: বল নিয়ে দাপাদাপি। রাজাবাজারে। —নিজস্ব চিত্র।
মাথার কাপড়টা কষে বেঁধে প্যাচপেচে কাদায় সালোয়ার সামলে বল পেটাচ্ছেন আলফিসা হুসেন। চোখমুখে এগারো ক্লাসের সারল্য, ‘‘আমি কিন্তু উঠে খেলব, গোল করব! ব্যাকে থাকতে ভাল লাগে না।’’
আলফিসার থেকে বয়সে বছর দশেকের বড় তাহসিনা বানো অবিশ্যি বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কোথায় খেলবেন। দু’বছরের দস্যি ছেলের মা শেষমেশ ভেবেচিন্তে বারপোস্টের নীচে ‘গোলকি’ হয়েই দাঁড়ালেন।
কলকাতার রাজাবাজারের গুল ময়দানের নামমাত্র মাঠ, হৃষিকেশ পার্ক বা সায়েন্স কলেজ তল্লাট মাতিয়ে রাখে এমনই উন্মাদনা। ছেলেরা খেলছে বলে মাঠ পেতে এক-এক দিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। তবু সহজে দমে না মেয়েরা। বৃষ্টি মাথায় জমজমাট প্রমীলা-ব্রিগেডের ফুটবল প্র্যাকটিস!
বহরমপুরের স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড চত্বরেও নৈহাটির দেবস্মিতা কুণ্ডু, কেরল থেকে আসা ছাত্রী স্টেফানি সানি, অর্পিতা কেএস-দের বল পায়ে দাপাদাপি শুরু হয় বিকেল হলেই। দিনভর কলেজের ধকলেও এক ফোঁটা ক্লান্তি নেই। আজ, শনিবার রাজাবাজারের মাঠেই অভিনব ফুটবল আসরে মুখোমুখি হতে চলেছে দু’পক্ষ।
কলকাতার রাজাবাজার পাড়া আর বহরমপুরে পড়তে যাওয়া মেয়েদের ভাগ্য কী অদ্ভুত মিলে গিয়েছে! মেয়েরা বল পিটিয়ে ধিঙ্গিপনা করবে, এমনটা অনেকেই চাননি। তাতেই তীব্র হয়েছে ছক-ভাঙার জেদ। বহরমপুরের ছাত্রী দেবস্মিতা বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় টিভি-তে বিশ্বকাপের টানেই ফুটবল-প্রেম। মেয়ে বলে ফুটবল খেলতে পারব না, এমন গাজোয়ারি মানতে পারিনি!’’ রাজাবাজারের মেয়েদের দলের পাণ্ডা সাহিনা জাভেদের কাছে আবার ফুটবলটা নিছকই খেলা নয়। নাবালিকার বিয়ে, গৃহহিংসার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেই একজোট হয়েছিলেন ওঁরা ক’জন। ক্রমশ আদল পেয়েছে নানা বয়সের মেয়েরা মিলে টিম করে ফুটবলের ভাবনা। সাহিনার কথায়, ‘‘মেয়েরা কি স্রেফ ঘরের বৌ হবে? একটু ফুটবল খেললে মেয়েদের নিয়ে পুরনো ধারণাগুলো অন্তত পাল্টাবে!’’
আরও পড়ুন: ছেলে মানুষ করতে মায়ের মারণ খেলা মরণ-কুয়োয়
বাস্তবিক ঘটেছেও তাই। তাহসিনার বর মহম্মদ মানোয়ার এখন বৌয়ের ফুটবল-প্রেমে উজ্জীবিত। গোড়ায় ‘পাড়ায় না-খেললেই তো ভাল হয়’ গোছের অবস্থান ছিল তাঁর। এখন তাহসিনার ম্যাচ নিয়ে নিজেও বেশ আগ্রহী মানোয়ার। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম বর্ষ মেহজবিন নাজ বা এথিনিয়াম স্কুলের বারো ক্লাসের নেহা খাতুনরা কয়েক মাস আগে মুম্বইয়ে ‘ট্যুর্নামেন্ট’ খেলে এসেছেন। তার পরেও মহল্লার অনেকেই এই মেয়েদের সম্ভ্রমের চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
বহরমপুরের ছাত্রীদের ফুটবল-আবেগও কিছুটা সংক্রমণের মতো মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কেরল থেকে আসা কয়েক জন ছাত্রী ভাষা-সমস্যায় বেশ মুখচোরা হয়ে থাকতেন। ফুটবলের মাতামাতি তাঁদের জড়তা কাটিয়ে দিয়েছে। মাথায় পাঁচ দশ-এগারো, গোলকিপার দামিনী সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘আগে তেমন না খেললেও বিকেলটা ফুটবল ছাড়া ফাঁকা লাগে।’’ একটু মোটা চেহারার জন্য হীনম্নন্যতায় ভোগা দু’-এক জন মেয়ের জীবনেও ফুটবল এখন স্পর্ধারই নামান্তর। কলেজের কয়েক জন ছাত্রও এই সহপাঠিনীদের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফুটবলকে সামনে রেখে গড়ে উঠছে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার তাগিদ।
সদ্য সেমেস্টার শেষ হওয়ায় বহরমপুরের খেলুড়েরা কেউ কেউ অবশ্য এই ম্যাচে থাকতে পারছেন না। তবে দু’দিকে ৭-৮ জনের টিম গড়ে প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে। স্নিকার্স, খালি পা, লেগিংস, সালোয়ার— যার যেটায় সুবিধে খেলবেন, ঠিক করেছেন সকলে। ফুটবলের হাত ধরে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর প্রয়াস ইদানীং দেশ জুড়েই দেখা যাচ্ছে। রাজাবাজারে ফুটবল উপলক্ষে বয়ঃসন্ধির মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মশালাও বসার কথা।
গোটা কর্মকাণ্ডের নাম ‘ফ্রি-কিক: টু দ্য গোল অব ফ্রিডম’। রাজাবাজারের ঘাস-ওঠা মাঠে ফুটবলে লাথিই মুক্তির কথা বলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy