সেই বিগ ব্যাং।
বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরের সেকেন্ডে পৌঁছে গেলেন বিজ্ঞানীরা! এই সে দিন। আর রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই ‘মাহেন্দ্রক্ষণে’ পৌঁছে গিয়ে পদার্থের সম্পূর্ণ নতুন একটা অবস্থার হদিশ পেয়ে গেলেন তাঁরা। যে অবস্থাটার কথা তাঁদের কস্মিন কালেও জানা ছিল না। দেখলেন, কণাদের কাটা হাত-পা, আত্মাও!
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ঠিক আগের মুহূর্তে যে মহা-বিস্ফোরণ হয়েছিল, তাকেই আমরা বিগ ব্যাং বলে জানি। সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ঠিক এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ পরেই যে ঘটনা ঘটেছিল, এই সে দিন তাজ্জব বনে গিয়ে সেটাই চাক্ষুষ করলেন বিজ্ঞানীরা।
বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরের সেই সময়ে পৌঁছে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যা দেখেছেন, তাতে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছে! একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তাঁরা বিস্ফারিত চোখে বলাবলি করতে শুরু করেছেন, ‘‘হচ্ছেটা কী? এটা আবার হয় নাকি?’’
এমনটা তো সত্যি-সত্যিই এত দিন জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের! জেনিভার অদূরে ভূগর্ভে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের (এলএইচসি) ‘অ্যালিস’ ল্যাবরেটরিতে পদার্থ বা ম্যাটারের একেবারে নতুন একটি অবস্থার খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি তো আলাদা হয়েই যায় ওই অবস্থায়, এমনকী, কণাদের ‘দেহ’ থেকে ‘আত্মা’কেও আলাদা করা সম্ভব! আমরা যাকে ‘একাত্মা’ বলে জানি, সেটাও আদতে ‘একাত্মা’ নয়। তার মধ্যেও রয়েছে দু’টি সত্তা। দু’ধরনের অস্তিত্ব।
বিগ ব্যাং-এর পরের এক সেকেন্ডের বিভিন্ন ভগ্নাংশ সময়ে যা যা ঘটেছিল
টেলিভিশনে হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ হলে যা দেখি। এটা সেই বিগ ব্যাং-এর বিকিরণেরই ‘ভস্মাবশেষ’
সেটা কী রকম?
কোয়ার্ক কী জিনিস? দেখুন অ্যানিমেশন
কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেসের (আইএসিএস) অ্যাকাডেমিক ডিন, বিশিষ্ট কণা-পদার্থবিদ সৌমিত্র সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘কোনও মৌলিক পদার্থের (হিলিয়াম, হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন) পরমাণুর হৃদয়ে (নিউক্লিয়াস) যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলি থাকে তার একটি প্রোটন (ধনাত্মক আধান বা চার্জের কণা), অন্যটি একেবারে ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ নিউট্রন (যার ধনাত্মক বা ঋণাত্মক কোনও আধানই নেই)। সেই প্রোটন আর নিউট্রনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলিও গড়ে ওঠে কোয়ার্ক ও অ্যান্টি-কোয়ার্কের মতো আরও ছোট ছোট কণিকা দিয়ে। ছ’ধরনের কোয়ার্ক রয়েছে। আপ, ডাউন, টপ, বটম, চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক। এই কোয়ার্কগুলির মধ্যে ওজনে বেশ কিছুটা ভারী স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক। স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক প্রোটন ও নিউট্রনের শরীর গড়ার ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নেয় না। কারণ, বেশি ভর বা ওজন মানেই বেশি শক্তি (আইনস্টাইনের e=mc2 সমীকরণ)।
সেই বিগ ব্যাং
ওই ‘বহুরূপী’ কোয়ার্কগুলিকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রাখে গ্লুওন নামে আরও একটি খুব ছোট্ট কণা। স্ট্রং ফোর্স বা অত্যন্ত শক্তিশালী বলের বাঁধনে। এই ব্রহ্মাণ্ডে বল বা ফোর্স রয়েছে মোট চার রকমের। মহাকর্ষীয় বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, দুর্বল (উইক) বল আর শক্তিশালী (স্ট্রং) বল। নামেই মালুম, চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী স্ট্রং ফোর্সই। যা আবার সবচেয়ে কম এলাকার মধ্যে কার্যকরী থাকে। এত দিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, দু’টি আপ আর একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে গড়ে ওঠে প্রোটন কণার শরীর। তার শরীরে আর কিছুই থাকে না। এও জানতেন, সেই প্রোটনগুলি বা তাদের শরীরে থাকা আপ আর ডাউন কোয়ার্কগুলিকে খুব জোরালো বলে যে বেঁধে রাখে, তার নাম গ্লুওন।
কোয়ার্ক থেকে কী ভাবে গড়ে ওঠে অণু, পরমাণু, দেখুন ভিডিও।
সেই বলের জোর এতটাই যে, কোয়ার্ক আর গ্লুওন কণাগুলিকে আলাদা করা যায় না। কোয়ার্ক বা প্রোটনগুলিকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রাখতে গ্লুওন কণাগুলি কাজ করে অনেকটা স্প্রিংয়ের মতো। স্প্রিংকে যেমন টানলে তা আরও সঙ্কুচিত হয়ে আগের অবস্থায় ফেরার জন্য আরও বেশি করে ‘উৎসাহী’ হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন ভাবেই একটি প্রোটন কণাকে আরেকটি প্রোটন কণা থেকে দূরে সরাতে গেলে তা আরও বেশি করে একে অপরের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। অনেকটা ‘ছাড়ালে না ছাড়ে অতি পুরাতন ভৃত্য’ গোছের অবস্থা। বা, কোনও জমজমাট দাম্পত্যের কথাই ধরুন। স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে আকছার বচসা হচ্ছে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে এসে যদি কেউ সেই দাম্পত্যে চিড় ধরানোর চেষ্টা করে, তা হলে আদর্শ দাম্পত্যের ক্ষেত্রে স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে বন্ধনটা আরও জোরালো হয়ে যায়।’’
যে ভাবে আপ (ইউ), ডাউন (ডি) কোয়ার্ক আর গ্লুওন দিয়ে গড়ে ওঠে প্রোটন, নিউট্রনের শরীর
তাপমাত্রা বা শক্তি (যাকে বলা হয় ‘এনার্জি ডেনসিটি’) কম থাকলে একটি কোয়ার্ক থেকে অন্য কোয়ার্ককে বা কোয়ার্ক থেকে গ্লুওন কণিকাকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না। তারা জড়িয়ে থাকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে। যেন ‘একাত্মা’! কিন্তু তাপমাত্রা বা শক্তির পরিমাণ যদি এক লাফে অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সেই বন্ধনে ফাটল ধরে। কোয়ার্ক-গ্লুওনের খুব জোরালো ‘দাম্পত্য’ ভেঙে যায়। তৈরি হয় একটি স্যুপের। কোয়ার্ক, অ্যান্ট-কোয়ার্ক আর গ্লুওনের সেই স্যুপকে বলা হয় ‘কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা’(কিউজিপি)। যা অসম্ভব রকমের তাপমাত্রায় কোনও পদার্থের অত্যন্ত গরম ও ঘন অবস্থা।
সেই তাপমাত্রাটা কত, জানেন?
তিন কণা-পদার্থবিজ্ঞানী। (বাঁ দিক থেকে) বিকাশ সিংহ, ফ্রেডরিকো আন্তিনোরি ও সৌমিত্র সেনগুপ্ত
সল্টলেকের ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের অধিকর্তা বিশিষ্ট কণা-পদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলছেন, ‘‘ব্রহ্মাণ্ড-সৃষ্টির আগে যে মহা-বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং হয়েছিল, তার এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই সেই তাপমাত্রাটা কিন্তু নেমে গিয়েছিল ঝুপ করে। কারণ, তখন প্রচণ্ড গতিতে, অসম্ভব দ্রুত হারে ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করেছিল এই ব্রহ্মাণ্ড। এটাকেই বলে ‘ইনফ্লেশন’। সেই সময়েই কোয়ার্ক, অ্যান্টি-কোয়ার্ক, গ্লুওনের মতো কণিকাগুলির জন্ম হতে শুরু করে। যে সব মৌলিক পদার্থের ‘হৃদয়’টা বড়, নিউক্লিয়াসটা বেশ ভারী (মানে, যাদের নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রন কণাদের সংখ্যাটা বেশি), তাদের মধ্যে খুব বেশি তাপমাত্রায় সংঘর্ষ (কলিশন) ঘটালে কোনও পদার্থের যে এই ধরনের অদ্ভুত অবস্থার (কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা) জন্ম হয়, এটা আগে অবশ্য জানতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ’৯০-এর দশকে সার্নের ভূগর্ভস্থ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারেই তার হদিশ মিলেছিল। কিন্তু যেটা মজার ঘটনা, তা হল, বিগ ব্যাং-এর পর পরই (বা, পরের সেকেন্ডে) তো আর ভারী নিউক্লিয়াসের মৌলিক পদার্থের জন্ম হয়নি। তার জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর বহু কোটি বছর পর। বিগ ব্যাং-এর পরের সেকেন্ডে ছিল শুধুই প্রোটন, নিউট্রনের মতো পদার্থের নিউক্লিয়াসের ‘রত্ন’দের শরীর বানানোর ‘কারিগর’রা। কোয়ার্ক, অ্যান্টি-কোয়ার্ক, গ্লুওনের মতো ‘ইউনিট’ কণিকাগুলি। বাড়ি বানাতে যেমন ইট লাগে, সেগুলি ছিল তেমনই প্রোটন, নিউট্রন বানানোর ইট, বালি, পাথর, চুন, সুরকি।’’
কাকে বলে কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা? দেখুন ভিডিও
তা হলে এ বার সার্নের সাফল্যটা কোথায়?
সৌমিত্রবাবু বলছেন, ‘‘এলএইচসি-তে এ বার সার্ন পদার্থের ওই অদ্ভুত অবস্থাটিই চাক্ষুষ করতে পেরেছে প্রোটন কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে। ৭ টেরা-ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তিতে। বিগ ব্যাং-এর এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে যখন হু হু করে ফুলে-ফেঁপে উঠছিল গোটা ব্রহ্মাণ্ড, তখন মোটামুটি ওই পরিমাণ শক্তিরই উদ্ভব হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। ওই শক্তিতে প্রোটন কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে কণাদের ‘দেহ’ থেকে ‘আত্মা’কে আলাদা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। তৈরি করতে পেরেছেন সেই অদ্ভুত অবস্থা, যার নাম ‘কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা’। শুধু তাই নয়, দেখেছেন, সেই অবস্থায় স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক কণিকাকেও। যা এর আগে শুধুই ভারী নিউক্লিয়াসের পদার্থের পরমাণুগুলির মধ্যে সংঘর্ষে দেখা গিয়েছিল।’’
সার্নের ‘অ্যালিস’ গবেষণাগার (ওপরে), সার্নের ঘোষণা (নীচে)
আনন্দবাজারে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে জেনিভা থেকে সার্নের ‘অ্যালিস’ গবেষণাগারের মুখপাত্র ফ্রেডরিকো আন্তিনোরি ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘এ বার অ্যালিসে আমরা যেটা দেখেছি, সেটা কোনও তাত্ত্বিক মডেলেই (পড়ুন, স্ট্যান্ডার্ড মডেল) বলা ছিল না। আমরা রীতিমতো অবাক হয়ে দেখেছি, ওই প্রচণ্ড শক্তিতে (বিগ ব্যাং-এর পরের এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ে যে শক্তির উদ্ভব হয়েছিল) প্রোটনের সঙ্গে প্রোটন কণাদের সংঘর্ষ ঘটালে অন্য যে কণাগুলি জন্মায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে আর অনেক বেশি দ্রুত হারে জন্মাচ্ছে কোয়ার্কদের মধ্যে বেশ ভারী স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক।’’
আরও পড়ুন- এ বার বাতাস থেকে জল টেনেই মেটানো যাবে তেষ্টা!
প্রোটনের শরীরে যা নেই, সেই স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক পাওয়া গেল কী ভাবে?
সৌমিত্রবাবুর কথায়, ‘‘এটা দু’ভাবে হতে পারে। প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের ফলে যে কিউজিপি তৈরি হলস সেখানে থাকা গ্লুওন কণিকাদের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে জন্ম হতে পারে ওই স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্কের। না হলে, কোয়ার্ক ও অ্যান্টি-কোয়ার্কের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে জন্মাতে পারে স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক।’’
ছবি সৌজন্যে: সার্ন, জেনিভা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy